চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসন: খুনের রাজ্যে কি হতে পারে নির্বাচন?
নিজস্ব প্রতিবেদক | সিটিজি পোস্ট
প্রকাশিত হয়েছে: ১০ নভেম্বর, ২০২৫

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় এসেছে ভিন্ন চিত্র। দলের বহু সিনিয়র ও আলোচিত নেতা এবার মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
সোমবার (৩ নভেম্বর) রাতে গুলশানস্থ চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভা শেষে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মোট ১৩টি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন। তবে চট্টগ্রামের ছয়টি ও কক্সবাজারের একটি আসনে এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি।
দলীয় সূত্র জানায়, স্থানীয় নেতৃত্বের অবস্থান, জোটগত সমন্বয় এবং কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এসব আসনে প্রার্থী নির্ধারণে সময় নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে ঘোষিত তালিকায় পরিবর্তন বা সংযোজনের সুযোগও রাখা হয়েছে।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “যুগপৎ আন্দোলনে যারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, তারা অনেক আসনেই প্রার্থী দিতে পারেন, আমরাও দিতে পারি। রাজনৈতিক সমন্বয়ের স্বার্থে তালিকায় পরিবর্তনের সুযোগ সবসময়ই থাকবে।”
রাউজানের অস্থির রাজনীতি
চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে উত্তর জেলার দুইটিতে এখনো বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনটি। বর্তমানে রাউজানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির ও সহিংস। গত কয়েক মাসে রাউজান কার্যত খুনের উপত্যকায় পরিণত হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি পদ স্থগিত হওয়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংসদ গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম আকবর খন্দকারের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই এই আসনের প্রার্থীতার সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে।
যদিও রাউজানে জোটবদ্ধ নির্বাচনে যাওয়ার সম্ভাবনা কম, তবুও এলাকা জুড়ে উত্তেজনা ও সহিংসতার কারণে সেই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।বিকল্প আলোচনায় রয়েছে জামায়াত, এনসিপি ও গণসংহতি।
এই আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং গণসংহতি আন্দোলন- এর দুই নেতার নাম আলোচনায় এসেছে। এই দুইজন হলেন, এনসিপির চট্টগ্রাম মহানগর শ্রমিক উইংয়ের সমন্বয়কারী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জিলানী এবং গণসংহতি আন্দোলনের চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সমন্বয়কারী নাসির উদ্দীন তালুকদার।
গণসংহতি আন্দোলন ইতিমধ্যে নাসির উদ্দীন তালুকদারকে মনোনয়ন দিয়েছে, তবে এনসিপি এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানায়নি। গুঞ্জন রয়েছে, এই আসনে মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জিলানীও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
এদিকে, আবার কেন্দ্রীয় জামায়াতে ইসলামী আগেভাগেই রাউজান উপজেলা আমীর মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জুকে চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে প্রার্থীতা দেওয়ার দরুন তিনি একাই রাউজানে আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে আছেন।
রাউজান নোয়াজিষপুর জামায়াতে ইসলামী রাউজান উপজেলার এক গণসংযোগকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ রাউজানের স্বপ্ন দেখে। যেখানে হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না, কোনো মা-বোন হীনমন্যতায় ভুগবেন না। আমাদের স্বপ্নের রাউজান গড়তে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। আসন্ন নির্বাচনে দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিয়ে সেই সুন্দর রাউজান গঠনের সাক্ষী হোন।”
বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব
চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থিতা নিয়ে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খন্দকারের মধ্যে।
গত শুক্রবার (৭ নভেম্বর) রাউজান সরকারি কলেজ মাঠে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, “যতদিন এই দেশের মানুষের রক্তের সঙ্গে আমার রক্ত মিশে আছে, ততদিন আমাকে ভোট থেকে কেউ বাদ দিতে পারবে না। যেকোনো মূল্যে আমি আগামী নির্বাচনে অংশ নেব।”
তিনি আরও বলেন, “রাউজানকে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে। এখানে ভাড়াটে খুনি বা চাঁদাবাজদের কোনো স্থান নেই। রাউজানকে বাংলাদেশের কলঙ্কিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা মানুষ মারে, চাঁদাবাজি করে, তাদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। রাউজানবাসী আর কলঙ্ক নয়, সম্মানের রাউজান চায়।”
সিটিজিপোস্টের পক্ষ থেকে গোলাম আকবর খন্দকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোনে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের অবস্থান
গণসংহতি আন্দোলনের নাসির উদ্দীন তালুকদার বলেন, “আমরা বিএনপির শরিক দল নই, তবে যুগপৎ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছি। কিছু আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেনি, তবে এটিকে এখনই আসন সমঝোতা বলা যাবে না। যদি সমঝোতা হয়, তাহলে কোন আসন ছাড়বে—তা এখনো নির্ধারিত হয়নি।”
অন্যদিকে এনসিপি নেতা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জিলানী বলেন, “এটি দলের সিদ্ধান্ত। পরিস্থিতি অনুযায়ী দল যেটি চূড়ান্ত করবে, সেটিই মেনে নেওয়া হবে।”
রাউজানে সহিংসতার ভয়াবহতা
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষাপটে রাউজান পরিণত হয়েছে এক আতঙ্কের রাজ্যে। বিএনপির দুই গ্রুপের বিরোধকে কেন্দ্র করে গত ১৪ মাসে ১৭টি পরিকল্পিত টার্গেট কিলিং সংঘটিত হয়েছে। এসব হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন ৩৫০ জনেরও বেশি এবং সংঘর্ষ ঘটেছে অন্তত ১০০ বারেরও বেশি।
এখন পর্যন্ত কোনো হত্যাকারীকে চিহ্নিত করা যায়নি। নিহতরা সবাই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, রাউজানের এই ধারাবাহিক হত্যার পেছনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই প্রধান কারণ।
রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া স্বীকার করেছেন, “অনেক হত্যাকাণ্ড আগেই পরিকল্পিত থাকে এবং অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ঘটানো হয়, তাই প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।”
তদন্তে তেমন অগ্রগতি না হলেও ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করেছিল। তবুও এ ধরনের ধারাবাহিক টার্গেট কিলিং বন্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
অনিশ্চয়তায় রাউজানের ভোট রাজনীতি
নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও রাউজানে আতঙ্ক কাটছে না। রাজনৈতিক সহিংসতা ও নেতৃত্বের বিভক্তি সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগ বিরাজ করছে।
এখনো স্পষ্ট নয়, বিএনপি এই আসনে কাকে মনোনয়ন দেবে, কিংবা শরিক দলকে আসনটি ছাড়বে কিনা। এই অনিশ্চয়তা রাউজানবাসীর পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয়দের মতে, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের নীরবতা মানুষের ভয়কে আরও গভীর করেছে। মাসের পর মাস ধরে চলমান সংঘর্ষ ও খুনোখুনির মধ্যে নির্বাচনের আমেজ এখন জনমনে এক প্রকার আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছে।




