আর্টসেলের ঘুণে খাওয়া রোদ ও জীবনের পরিক্রমা: থার্ড পারসন ন্যারেটিভ

গান পর্যালোচনা

সিটিজি পোস্ট প্রতিবেদক

শাখাওয়াত হোসেন সাকিব | সিটিজি পোস্ট

প্রকাশিত হয়েছে: ১৮ অক্টোবর, ২০২৫

আর্টসেলের ঘুণে খাওয়া রোদ ও জীবনের পরিক্রমা: থার্ড পারসন ন্যারেটিভ

গান: ঘুণে খাওয়া রোদ

কথা: রুম্মান আহমেদ

ব্যান্ড: আর্টসেল

অ্যালবাম: অনিকেত প্রান্তর( No man's land)

কোনো গানের কথা দুই বা ততোধিক ভিউপয়েন্ট থেকে দেখা যায়। তবে স্পেসিফিকলি আর্টসেলের এই গানের ভিউপয়েন্ট প্রত্যেকটা লিসেনার'ই! গানের লাইনগুলোকে দেখতে হবে নিজের চোখ দিয়ে যেখানে আপনি রোদ,শহর,খয়েরী-নীল,বৃত্ত,ভয়,বিবর্ণ,সময়,আকাশ,সাদা-কালো,বস্তু,ছায়া-অপছায়া,ক্যানভাস ইত্যাদি দেখতে পারবেন কিন্তু নিজেকে দেখতে পারবেন না! মূলত আপনি একটা স্ট্যান্ডপয়েন্টে দাড়িয়ে নিজ চোখ দিয়ে সবকিছু অবলোকন করবেন অথবা আপনার লাইফের ডিজাস্টার ইন্সিডেন্টগুলোর সময়কার কেমন ফিল করেছেন সেই জায়গা থেকেও ভাবতে পারেন। যদিও এটা রুম্মান আহমেদের ভিউপয়েন্টে লেখা তারপরেও তিনি গানের প্রতিটি লাইনে লাইনে যেভাবে মেটাফোর ব্যবহার করেছেন এতে নিজের মত করে ভেবে নিতে পারেন শ্রোতার, সে সুযোগ লিরিসিস্ট করে দিয়ে গেছেন খুব সূক্ষ্মভাবে। হয়তো এটাই উনার প্রাপ্তি।

দৈন্যদিন ব্যাপার স্যাপার নিয়ে গানের কাহিনী হলেও যে যার যার মত করে ইন্ট্রারপ্রেট অথবা বুঝে নিবে সেই সুযোগ রুম্মান আহমেদ করে দিয়ে গেছেন বলে আমি মনে করি! এখানে প্রত্যেকটা প্যারা নিয়ে আমার মতামত ব্রিফ আকারে দেয়া যায়।

প্রথম প্যারায় বলা হয়তেছে:

"চারটি দেয়াল ক্রমশ

সরে আসে বৃত্তের ভেতরে

কমে আসে আলো,

বস্তুর চারিপাশ এখন নীরব। "

চমকে দেয়ার মত একটা অংশ! এই অংশকে কয়েকভাবে চিন্তা করা যায়। চাইলে কবরের সাথে রিলেট করা যায় অথবা দিনশেষে রাতে যখন ঘুমাতে যান; শোয়ার পর যেভাবে চিন্তাভাবনা আপনাকে হানা দেয় চার দেয়ালের মাঝে সেদিকটাও বিবেচনা করতে পারেন। কবরের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে দাড়ায়; চারকোণা কবরটার মধ্যে যখন একটা মানুষকে শোয়ানো হয়; মাটি পড়ার সাথে সাথে তার মাথা বরাবর আকাশের দিক থেইকা আলো আস্তে আস্তে কমতে থাকে আর মনে হয়তে থাকে চারকোণা কবরটা ক্রমশ ছোট হইতে হইতে গায়ের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে এবং একটা সময় কবর দেয়া শেষে চারপাশটা নিরব হয়ে পড়ে! এইখানে অবশ্য সোল বা আত্মার দিক দিয়ে এই জিনিসটা বিবেচনা করা যেতে পারে। যেইটাকে মেটাফিজিক্যালি দেখা যায়। অর্থাৎ আপনার সোলের পার্সপেক্টিভের কথাবার্তা; এরকম আরকি।

আর যদি চিন্তার সাথে রিলেট করি তাইলে এইখানে বৃত্ত বলতে নিজের মাথাটাকে বুঝাইতেছে যেখানে আমাদের যত চিন্তাভাবনার আতুরাশ্রম। (চিন্তাভাবনারে আতুরাশ্রম বলার কারণ হয়তেছে চিন্তাভাবনা তো আমাদের অতিথি! যে আসে আর যাই, ভাঙ্গে, নষ্ট করে, ধ্বংস কইরা স্বীয়রে পরিবর্তন কইরা মেরুদন্ড শক্ত কইরা দুনিয়ায় নামায় দেয় সুন্দর কইরা) চিন্তার জগতে নিজেকে ছেড়ে দেয়ার পর রাত বাড়ে, দুনিয়ার আলো -বাতাস পর্যন্ত বন্ধ হইয়া চারপাশটা নিরব হইয়া পড়ে কিন্তু আপনার অতিরিক্ত চিন্তা বা দুশ্চিন্তার মাত্রা কমে না! চিন্তা যেভাবে প্রকট হইতে থাকে মনে হয় যেনো চারটা দেয়াল ক্রমশ চিন্তা হয়ে সরে আসে মাথার দিকে।

২য় প্যারা:

রঙ মূলত সাদা কালো

অন্ধকারের ছায়া-অপছায়া বোধ।

অথবা খয়েরী নীল আকাশ

অনেকটা ঘুণে খাওয়া রোদ

লেগে থাকে আকাশের গায়ে

সময়ের রঙহীন ক্যানভাস

আমার জানালায়।

এই পুরো অংশটাকে আমি ঘুমানোর পর যখন স্বপ্ন দেখি সেইটার সাথে রিলেট করতে চাচ্ছিলাম। আগের প্যারাতে তো চারপাশ নিরব হয়ে গেছে; তারমানে চিন্তা করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম তারপর থেকে গানের পরের লাইনগুলোর সিন ক্রমে ক্রমে আসতে থাকে। তো শুরু হচ্ছে 'রঙ মূলত সাদা কালো' থেকে। অর্থাৎ স্বপ্ন আমাদের কাছে সাদা-কালা টিভির মত।আপনি রঙিন স্বপ্ন দেখে থাকলে গুড! বাট রিসার্চে আছে সাদা ও কালো রং মূলত মানুষ দেখে থাকে স্বপ্নে! এরপর যাবতীয় যা চিন্তা করতেছিলেন ওই চিন্তাগুলো স্বপ্ন হয়ে হানা দিলো। এমন একটা অন্ধকারে আছেন যেখানে দূরে কিছু দেখতে পাচ্ছেন তবে সেটা কি ছায়া নাকি অপছায়া ওই বোধও আপনার মধ্যে সন্দেহ তৈরি করে দিয়েছে। যেভাবে অন্ধকারের আবছা আলোয় কোনো রশিকে দূর থেকে সাপ মনে হয় ঠিক তেমন'ই! এরপর খয়েরী ও নীল কালারের মিশ্রনে যে আকাশটার রং তৈরি হয়েছিলো ওইটাকে দেখতে ঘুণে খাওয়া রোদের মত যেটা পুরো আকাশকে ক্যানভাসে পরিণত করছে কিন্তু রঙ ছাড়া ধোয়াশার মত! অর্থাৎ রোদে যেমন ঘুণ ধরে না ;ঠিক তেমনি ক্যানভাস রং ছাড়া হয় না! এবং এই সব'ই আপনি অবলোকন করতেছেন জানালার পাশে বসে, ভ্রমের মধ্য দিয়ে।

৩য় প্যারা:

স্বপ্ন এখন এগারো সাতাশ

শুন্যের ওপর দেখ, দেখো দাঁড়ায়

সম্মোহিত শহর

বাতাসের চোখে আজ, চোখে আজ

নেশার উৎকট আলো।

এইখানে 'স্বপ্ন এখন এগারো সাতাশ' এটা আসলে কি বুঝাইছে তা ক্লিয়ার না! আপাত দৃষ্টিতে ১১:২৭টা বুঝায় বাট এইখানে অন্যকিছু থাকতে পারে! তবে এই লাইনটাকে সবচেয়ে বড় মেটাফোর হিসাবে ধরতে পারি আমরা এবং যার উত্তর শুধু রুম্মান আহমেদের কাছেই আছে! তবে ১১:২৭ টা সময়কে রাত ধরে আগানো যায়!

তো অনেকটা উপরে ওঠে দেখা যায় পুরো শহর! বাতাস উড়ে উড়ে নিয়া গিয়ে শহরটারে দেখাইতেছে আর মানুষের রং তামাশার পসরা দেখে পুরো শহর মানুষের রং তামাশার আলোয় পরিণত হয়েছে যেটাকে নেশা বলা হচ্ছে! পার্সন টু পার্সন ভ্যারি করে কার কি ধরনের নেশা আছে দুনিয়াতে! দুনিয়াতে বিভিন্ন ধরনের নেশার ফলে চিন্তার কারণ হচ্ছে এবং এখানেই দেখা যাচ্ছে আমরা যে অন্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরি আর এটার জন্য একটা যে অস্থিরতায় চিন্তার জোন তৈরি করে বারবার পড়ে যাচ্ছি! যা বৃত্তের অনুরণন বাড়াচ্ছে।

৪র্থ প্যারা:

রঙ মূলত সাদা কালো..

অন্ধকারের ছায়া অপছায়া বোধ

অথবা খয়েরী নীল আকাশ-

অনেকটা ঘুনে খাওয়া রোদ

লেগে থাকে আকাশের গায়,

বিবর্ণ সময়ের,

জানালায় আজ ঘুণে খাওয়া রোদ।

- এই অংশ নিয়ে কথা হয়েছে।

৫ম প্যারা:

আমার শরীর মানে আমি

ও ছায়া, ছায়া মানে মৃত রোদ

আত্মহুতি দেয় তাদের আলোর যৌবন সারাক্ষণ,

মেঘে মেঘে ঢাকা পড়ে চেনা অচেনা কত মুখ,

ছায়ার শরীর ছায়ায় বাঁচে আলোর ভয়।

এখন শেষের পালা! মানে ঘুম ভাঙ্গার সময় ঘনিয়ে আসছে ! এই অংশটার গভীরতা আমাকে অনেক ভাবিয়েছে! এখানে নিজের শরীর ও ছায়ার যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না, সেটার আর্তনাদ ফুটে উঠেছে একটা তিক্ততার সূরে! যখন পার্থক্য করা যাচ্ছে না তখন জোর গলায় বলতে চাচ্ছে যে ছায়াটা একটা মৃত আমি; যেটা মৃত্যু কামনা করে! এই ছায়ার ফর্মে সে থাকতে চাই না! এই ছায়াগুলোর মৃত্যু হয় বারবার! প্রতিটা মৃত্যুতে তার মানুষ চেনা হয় মানুষ ভুলা হয়; নতুন একটা আমিতে পরিণত হয়! এই ছায়াদের বারবার মৃত্যুর ফলে নতুন করে নতুন আলোর সন্ধানের ভয় তার নেই! মানে একটা সময় এসে বুঝতে পারে যে নতুন আলোর সন্ধানে ছায়াদের অনুসরণ না করে আলোর সন্ধান বহাল রাখা!

পরিশেষে বলা যায়, স্রোতের প্রতিকূলে আগায়তে না পারলে ভাইসা থাকা যায় ; এইটাই গানের মোটিফ!

গানটির মূল বার্তা হিসেবে ধরা যায়; জীবন মানে ক্রমাগত পরিবর্তন, আত্ম-সংগ্রাম ও অনুসন্ধান। স্রোতের প্রতিকূলে না চলতে পারলে স্থির থাকা যায়, কিন্তু সেই স্থিরতাই “ঘুণে খাওয়া রোদ”-এর মতো বিবর্ণ ও শোষিত। গানটি তাই মানুষকে নিজের ভিতরে আলো খোঁজার, চিন্তার অন্ধকার ভেদ করার তাগাদা জানায়।

লেখার সময়কাল: ২০২১ সাল।

Senior Content Writer Profile LinkedIn Banner

ক্যাটাগরি:
ফিচারমতামতসাহিত্য