শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তায় ট্রাইবেকারে পদুয়ার ঐতিহাসিক শিরোপা জয়

সিটিজি পোস্ট প্রতিবেদক

শেখ মোহাম্মদ ফয়সাল | সিটিজি পোস্ট

প্রকাশিত হয়েছে: ৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তায় ট্রাইবেকারে পদুয়ার ঐতিহাসিক শিরোপা জয়

শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টান টান উত্তেজনা! পুরো ৯০ মিনিট দর্শকদের নিঃশ্বাস যেন আটকে ছিল মাঠজুড়ে। নাটকীয়তায় ভরপুর লোহাগাড়া উপজেলা প্রশাসন কাপ ফুটবলের জমজমাট ফাইনালে নির্ধারিত সময়ের সমতা ভাঙে ট্রাইবেকারে। আর সেই রোমাঞ্চঘন ট্রাইবেকারে আমিরাবাদ ইউনিয়নকে ৪-২ গোলে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে চ্যাম্পিয়নের ট্রফি নিজেদের করে নেয় পদুয়া ইউনিয়ন ফুটবল দল। মাঠজুড়ে উচ্ছ্বাস, উৎসব, আর বিজয়ের পতাকা—পদুয়াবাসীর কাছে এই জয় যেন এক রূপকথার ফুটবল সন্ধ্যা।

শনিবার (৬ ডিসেম্বর) দুপুর গড়াতেই লোহাগাড়ার ঐতিহাসিক কর্ণেল অলি আহমদ বীর বিক্রম স্টেডিয়াম পরিণত হয় দর্শকদের মিলনমেলায়। চারদিক থেকে ছুটে আসা মানুষের ঢলে গ্যালারী ভরে ওঠে চোখের পলকে।

আমিরাবাদ ইউনিয়ন বনাম পদুয়া ইউনিয়নের বহুল প্রতীক্ষিত ফাইনালকে ঘিরে উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে—কারণ টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত নৈপুণ্য, শৈল্পিক পাসিং আর ধারালো আক্রমণে দুই দলই দেখিয়েছে আধিপত্যের ছাপ। সেই অসাধারণ পারফরম্যান্সের পরই তারা পৌঁছায় স্বপ্নের ফাইনালের মঞ্চে, আর তাই ম্যাচ শুরুর আগেই স্টেডিয়ামজুড়ে তৈরি হয় এক উত্তেজনাকর পরিবেশ।

ঘড়ির কাটায় তখন দুপুর ২টা ৫১ মিনিট। পশ্চিম আফ্রিকার গাম্বিয়া থেকে আগত পদুয়া ইউনিয়নের ‘পগবা খ্যাত’ মুচেঙ্গার প্রথম বল ছোঁয়াতেই যেন তপ্ত হয়ে ওঠে কর্ণেল অলি আহমদ বীর বিক্রম স্টেডিয়ামের বাতাস। শুরু হয় ফাইনালের যুদ্ধ। আক্রমণ–পাল্টা আক্রমণে বারবার কেঁপে উঠে দুই দলের গোলবার, আর প্রতি মুহূর্তেই গ্যালারিতে সৃষ্টি হয় দর্শকদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস।

খেলার শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ফুটবলের ঝড় তোলে পদুয়ার ফুটবলাররা। তবে ম্যাচের ছন্দ ধরে রেখে নিয়ন্ত্রিত ফুটবল উপহার দেয় আমিরাবাদ একাদশ—যা মুহূর্তেই দর্শককে টেনে নেয় খেলায়। দর্শকদের ভাষ্যেও উঠে আসে সেই প্রশংসা: পাসিং অ্যাকুরেসি, অন-টার্গেট শট, বল পজিশন—সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে ছিল টিম আমিরাবাদ। বিশেষ করে নিখুঁত ড্রিবলিং, গতিময় দৌড় আর ধারালো আক্রমণে বারবার নজর কাড়েন তাদের স্ট্রাইকার সাজ্জাদ।

তবে সব উত্তেজনা ছাপিয়েও প্রথমার্ধে জালের দেখা পায়নি কোনো দল। নির্ধারিত সময়ের তীব্র লড়াই আর দারুণ সব সুযোগ নষ্টের পর গোলশূন্য অবস্থায়ই শেষ হয় ফাইনালের প্রথমার্ধ।

পদুয়া টিমের কাছে ফাইনালের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুটা ছিল স্বপ্নের মতো। রেফারির বাঁশির সঙ্গে সঙ্গেই আক্রমণের ঝড় তোলে পদুয়া ফুটবল একাদশ। আমিরাবাদের ডিফেন্স পেছন থেকে গুছিয়ে ওঠার আগেই ঘটে ম্যাচের সবচেয়ে বড় চমক—বদলি হিসেবে মাঠে নামা মাত্র ১৬ বছরের তরুণ মাহির প্রথম স্পর্শেই তুলে নেন গোল! তার বিদ্যুতগতির ওয়ান-টাচ শটে কিছু বুঝে উঠার আগেই হতভম্ব হয়ে যান আমিরাবাদের গোলরক্ষক সাকিব। বল আমিরাবাদের জাল স্পর্শ করতেই কর্ণেল অলি আহমদ বীর বিক্রম স্টেডিয়ামে সৃষ্টি হয় উচ্ছ্বাসের বিস্ফোরণ। লাফিয়ে ওঠে গ্যালারিভর্তি দর্শক, পতাকা উড়াতে থাকে পদুয়ার সমর্থকরা।

তবে গোল হজম করেই যেন জেগে ওঠে আমিরাবাদ। বক্সে একের পর এক তীব্র আক্রমণ, থ্রু পাস, উইং থেকে ক্রস—সব মিলিয়ে পদুয়ার ডিফেন্সকে পর্যুদস্ত করে তোলে তারা। বাড়তে থাকে ম্যাচের গতি, স্টেডিয়ামের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারির শেষ সারি পর্যন্ত। বহুল প্রতীক্ষিত সমতা তুলে নেয় ৮৪তম মিনিটে, আমিরাবাদের ৭ নং জার্সি পরিহিত সিদ্দীকের শট গোলরক্ষকের হাত ছুঁয়ে জড়িয়ে যায় জালে। স্কোরলাইন ১–১। আবারও জমে ওঠে ফাইনালের লড়াই।

শেষ মিনিটে দুই দলই তৈরি করে সুযোগ, কিন্তু জালের দেখা মেলেনি। নির্ধারিত সময় শেষে ম্যাচ গড়ায় ট্রাইবেকারে। কিন্তু দর্শকদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় টুর্নামেন্ট পরিচালনা কমিটিকে। দর্শকরা মাঠে প্রবেশ করায় প্রায় আধ ঘন্টা বন্ধ থাকে ম্যাচ। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সম্পন্ন হয় ট্রাইবেকার —যেখানে স্নায়ুচাপের যুদ্ধ শেষে পদুয়া ইউনিয়ন জয় ছিনিয়ে নেয় ৪–২ ব্যবধানে। আর সেই সঙ্গে কর্ণেল অলি আহমদ বীর বিক্রম স্টেডিয়ামে শুরু হয় পদুয়ার বিজয়োৎসব—উল্লাসে কেঁপে ওঠে চারদিক, স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখা সেই রাতে লেখা হয় নতুন ইতিহাস।

লোহাগাড়ায় ফুটবল মানেই ঈদ-উৎসব। গ্যালারিভরা উচ্ছ্বাস, আনন্দ আর খেলাধুলার সৌন্দর্য। কিন্তু ফাইনাল হারের পর আমিরাবাদ পক্ষের কিছু প্লেয়ার ও দর্শকের আচরণ সেই ক্রীড়া উৎসবকে মুহূর্তেই ম্লান করে দেয়। মাঠের ভেতরে প্লেয়ারদের উদ্দেশ্যে স্যান্ডেল নিক্ষেপ এবং পদুয়ার সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে, যা উপস্থিত সবাইকে হতবাক করেছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এমন আচরণ লোহাগাড়ার বহুদিনের গড়ে ওঠা ক্রীড়া-বন্ধু পরিবেশকে শুধু নষ্টই করছে না, বরং পুরো ক্রীড়াঙ্গনকে কলঙ্কিত করছে।

এই ঘটনাকে ঘিরে হতাশা প্রকাশ করেছেন পদুয়া ইউনিয়ন ফুটবল একাদশের টিম অফিসিয়াল মোরসেল মাহমুদ। ফেসবুকে ক্ষোভঝরা এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন— ‘আমাদের অপরাধ কি জানতে পারি? কেন আমার প্লেয়ারের গায়ে হাত তোললেন? কেন আমরা বিজয়ের আনন্দ মাঠে উদযাপন করতে পারলাম না? ইউএনও স্যারের পরিকল্পনা অনুযায়ী মঞ্চ প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানটা পণ্ড হলো কেন? এত সুন্দর আয়োজন তীরে এসে তরি ডুবানোর জন্য দায়ী কারা? আমি মোরসেল মাহমুদ, মুমিনুল হক ও গিয়াস ভাই সম্পূর্ণ ফেয়ার প্লে মেন্টালিটি নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্টে জড়িত হয়েছি। আমরা আমাদের দর্শক–সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি বলে বিশ্বাস করি। কোনো অসভ্যতা কি আমরা দেখিয়েছি? প্রশ্ন রাখলাম লোহাগাড়ার আপামর ফুটবল পাগল দর্শকদের কাছে।’

তার এই পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই মন্তব্য করছেন, খেলাধুলা মানেই সৌহার্দ্য ও প্রতিযোগিতার নান্দনিকতা; সেখানে বিশৃঙ্খলা ও হামলার মতো ঘটনা শুধু খেলাকে নয়, লোহাগাড়ার ক্রীড়া সংস্কৃতিকেই আঘাত করছে।

ম্যাচ শেষে উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় পুরস্কার বিতরণী। টুর্নামেন্ট সেরা, সেরা গোলরক্ষক, ম্যান অব দ্য ফাইনালসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সেরা খেলোয়াড়দের হাতে ট্রফি ও সম্মাননা তুলে দেন অতিথিরা।

মঞ্চে তখন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে সম্মাননা প্রদান করেন লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও লোহাগাড়া–সাতকানিয়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আসহাব উদ্দিন চৌধুরীসহ স্থানীয় ক্রীড়া ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।

ক্যাটাগরি:
চট্টগ্রাম দক্ষিণ