চসিকের রাজস্ব বিভাগের ঘষামাজায় উধাও ২০ কোটি টাকা

সিটিজি পোস্ট প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক | সিটিজি পোস্ট

প্রকাশিত হয়েছে: ২২ অক্টোবর, ২০২৫

চসিকের রাজস্ব বিভাগের ঘষামাজায় উধাও ২০ কোটি টাকা

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) রাজস্ব বিভাগের পৌরকর মূল্যায়নে ভয়াবহ দুর্নীতি ও আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটন করেছে চসিকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি।

তদন্ত সূত্রে জানা যায়, চসিকের রাজস্ব বিভাগের ৮নং সার্কেলে হোল্ডিং নং ৫১৫/৩/৫৯৪ (দক্ষিণ পতেঙ্গা মহল্লা) এবং হোল্ডিং নং ৩১৮/৩৩১ (দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর মহল্লা) এর ফিল্ড বুকে ঘষামাজা করে ২৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা থেকে কমিয়ে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা দেখানো হয়। অর্থাৎ ঘষামাজা করে ২০ কোটি টাকা কমিয়ে উপস্থাপন করা হয় আপিল রিভিউ বোর্ডে।

তদন্তে উঠে এসেছে, কর কর্মকর্তা, উপ-কর কর্মকর্তা, হিসাব সহকারী ও হোল্ডিং মালিকের যোগসাজশে এই আর্থিক কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে।

দীর্ঘ ১০ মাসের অনুসন্ধানের পর তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এই অনিয়মের সঙ্গে কর কর্মকর্তা নুরুল আলম ও উপ-কর কর্মকর্তা জয় প্রকাশ সেন সরাসরি জড়িত।

এছাড়াও বলা হয় হিসাব সহকারী আহছান উল্লাহ্‌ দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, তবে তদন্তে এসেছে তিনি উর্ধ্বতনদের নির্দেশে কাজ করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন।

তদন্তের প্রেক্ষাপট-

রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে হোল্ডিংগুলোর বার্ষিক মূল্যায়ন হয়েছিল, আর আপিল রিভিউ বোর্ডের শুনানি হয় ২০২১ সালের ১৩ জুন। অডিটে বিষয়টি ধরা পড়লেও তৎকালীন মেয়র ও চসিক কর্মকর্তারা বিষয়টি আমলে নেননি।

পরবর্তীতে বর্তমান মেয়র শাহাদাত দায়িত্ব নেয়ার পর ঘষামাজা ও বার্ষিক মূল্যায়ন পরিবর্তনের ঘটনায় প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় একটি ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, যা পরে ৫ সদস্যে উন্নীত হয়।

কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আইন কর্মকর্তা মহিউদিন মুরাদ এবং সদস্য সচিব ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরী। অন্যান্য সদস্য ছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৈতী সর্ববিদ্যা, শিক্ষা কর্মকর্তা রাশেদা আক্তার এবং ৮নং সার্কেলের কর কর্মকর্তা আব্দুল মাজিদ।

তদন্তে যা উঠে এসেছে-

প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি একটি “ষড়যন্ত্রমূলক কাজ” যা কর্পোরেশনকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য এই অনিয়ম করেন।

তদন্তে দেখা গেছে, ইছহাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ট্যাক্স পেয়ার লেজারে ঘষামাজার কোনো চিহ্ন নেই, কিন্তু এসেসমেন্ট লিস্টে ২৬ কোটির জায়গায় ৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা লেখা হয়। একইদিনে (১৩ জুন ২০২১) সংশোধিত তথ্য ট্যাক্স পেয়ার লেজারে লিপিবদ্ধ করা হয়, এবং ওইদিনই রিভিউ বোর্ডের শুনানি হয়। অর্থাৎ শুনানির পরই তথ্যে হেরফের করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদকদের দাবি, রিভিউ বোর্ডে আপিলের আগে সার্কেল অফিস থেকে সঠিকতার সার্টিফিকেট দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা দেয়া হয়নি।

তদন্তে হিসাব সহকারী আহছান উল্লাহ্‌ তার জবানবন্দীতে জানান, কর কর্মকর্তা নুরুল আলম ও উপ-কর কর্মকর্তা জয় প্রকাশ সেনের চাপে তিনি ফর্মে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ফিল্ড বুক ও সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট এ দুই কর্মকর্তার হেফাজতে ছিল।

তবে উপ-কর কর্মকর্তা জয় প্রকাশ সেন দায় অস্বীকার করে বলেন, ফিল্ড বুক, পাবলিশড কপি বা ট্যাক্স লেজার তার কাছে ছিল না। বরং তিনি দাবি করেন, ফিল্ড বুকে ঘষামাজা দেখে নুরুল আলমকে আপিল না উপস্থাপন করতে বলেছিলেন। কিন্তু নুরুল আলম তাকে বলেন, “এটা তোমার দেখার বিষয় না, মেয়র সাহেব দেখবেন।”

এদিকে কর কর্মকর্তা নুরুল আলম তার জবানবন্দীতে বলেন, “আমি আপিল ফরমে কোনো ঘষামাজা দেখিনি। ৮নং সার্কেলে ২৫-২৬ কোটি টাকার ৮-১০টি হোল্ডিং ছিল। তবে ইছহাক ব্রাদার্স ও ইনকন ট্রেড লিমিটেডের বিষয়টি আমার জানা ছিল না।”

এছাড়াও তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, হোল্ডিং মালিক ইছহাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডও এই অনিয়মের বেনিফিশিয়ারি। তাদের যোগসাজশ ছাড়া এমন ঘষামাজা সম্ভব নয়। এতে সিটি কর্পোরেশন বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

এসেসমেন্ট রিভিউ বোর্ড চলাকালীন সময় কর কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুল আলম, উপ-কর কর্মকর্তা জয় প্রকাশ সেন, কর আদায়কারী জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী ও হিসাব সহকারী আহছান উল্লাহ্‌ দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ৮নং রাজস্ব সার্কেলে কর্মরত ছিলেন।

এ বিষয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন জানান, “আগের মেয়রদের আমলে এসব অনিয়ম হয়েছে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

মেয়র ডা. শাহাদাত বলেন, আমি চাই, কর্পোরেশনে স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক।

সিটিজি পোস্ট/এইচএস

ক্যাটাগরি:
চট্টগ্রামঅপরাধ