একসময় যেখানে পাহাড়জুড়ে ছিল জুমচাষের ব্যস্ততা, এখন সেখানে বইছে মসলার ঘ্রাণ। আদা, এলাচ, দারুচিনি, গোলমরিচের মতো দামি মসলার চাষ পাহাড়ে এনে দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। জমি বাড়ছে, ফলন বাড়ছে, বাড়ছে কৃষকের লাভও। নারীরাও সরাসরি যুক্ত হচ্ছেন মাঠের কাজে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে। খাদ্যের সীমা ছাড়িয়ে এই খাত এখন হয়ে উঠছে অর্থনীতির সম্ভাবনাময় এক অধ্যায়।
এই পরিবর্তনের পেছনে আছে দেশের বিপুল মসলার চাহিদা। প্রতিবছর দেশে মসলার চাহিদা প্রায় ৫৯ লাখ টন হলেও উৎপাদন এখনও সীমিত। এর বড় একটি অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়, যার পেছনে ব্যয় হয় বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতেই পাহাড়ি কৃষকেরা ঝুঁকেছেন মসলা চাষে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অনুকূল মাটি ও জলবায়ু এ জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে পার্বত্য এলাকায় যেখানে মসলা চাষের জমি ছিল মাত্র ১,২০০ হেক্টর, ২০২৫ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২,৭৫০ হেক্টর। এই সময়ে আদা চাষ দ্বিগুণ হয়েছে, আর হলুদের চাষ বেড়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ।
বান্দরবানের উপপরিচালক (কৃষি) এম এম শাহ্ নেয়াজ বলেন, “২০২১ সাল থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হওয়া এলাচি ও দারুচিনির ফলন আমাদের খুব আশাবাদী করেছে। এখন এটি শুধু বিকল্প চাষ নয়, পাহাড়ে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠছে।” তিনি জানান, নারীরাও এই খাতে যুক্ত হচ্ছেন, যা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
জুমচাষের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে এখন পাহাড়ে জনপ্রিয় হচ্ছে গোলমরিচ, তেজপাতা, বিলাতি ধনিয়া, জিরা ও অন্যান্য উচ্চমূল্যের মসলা। কৃষকদের ভাষ্য, এই ফসলের ফলন যেমন ভালো, তেমনি বাজারমূল্যও বেশি—ফলে লাভজনক।
জামছড়ি ইউনিয়নের কৃষক রতন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “আগে ধান-কলার চাষ করতাম। এখন সাড়ে তিন একরে আদা, এলাচি আর হলুদ করি—ভালো আয় হয়।” রেশমা চাকমা বলেন, “আগে শুধু বাড়ির কাজ করতাম, এখন মাঠেও কাজ করি, মসলা শুকাই, বিক্রি করি—নিজের উপার্জনের পথ তৈরি হয়েছে।”
বাংলাদেশ মসলা গবেষণা কেন্দ্র বলছে, দেশে বার্ষিক প্রায় ৫৮.৫ লাখ টন মসলার চাহিদার মধ্যে আমদানি হয় প্রায় ৪৫ লাখ টন। ভারত, চীন, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আসে এসব মসলা। পাহাড়ি মসলা উৎপাদন বাড়ায় আমদানি নির্ভরতা কমছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালের উৎপাদন দিয়েই আমদানির ওপর নির্ভরতা অন্তত ৩০% কমানো গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এক বছরে মসলা আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। কৃষি গবেষকরা বলছেন, পরিকল্পিত সম্প্রসারণ হলে এই নির্ভরতা আরও ৩০–৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব।
মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রাসেল আহমেদ বলেন, “হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের বোঝাতে পেরেছি—একই জমি ও শ্রমেও মসলা চাষে আয় অনেক বেশি।”
তবে সবকিছুই সহজ নয়। সড়ক অবকাঠামোর দুর্বলতা ও বাজার ব্যবস্থার অভাবে অনেক কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। রাঙামাটির বরকল উপজেলার ব্যবসায়ী মাইন উদ্দিন বলেন, “রাস্তা খারাপ, তাই অনেক সময় পণ্য নষ্ট হয়, দামও কমে যায়।”
এই সমস্যা মোকাবিলায় সরকার ইতোমধ্যে বান্দরবান ও রাঙামাটিতে মসলা শুকানোর ইউনিট ও সংরক্ষণাগার নির্মাণ শুরু করেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের মধ্যে ১০০ কোটি টাকার মসলা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অর্গানিক হলুদ, আদা ও দারুচিনির চাহিদা তৈরি হয়েছে।
বান্দরবান হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক লিটন দেবনাথ বলেন, “মসলা চাষে স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যনিরাপত্তা ও আয়—দুই-ই বাড়ানো সম্ভব। তবে সফল রপ্তানির জন্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত ও মান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সমন্বয় জরুরি।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশিক্ষিত জনবল, মান নিয়ন্ত্রণ ল্যাব এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে পাহাড়ি মসলাকে রপ্তানিযোগ্য একটি ব্র্যান্ডে রূপান্তর করা সম্ভব। তখন বাংলাদেশের ‘পাহাড়ি মসলা’ বিশ্ববাজারে ছড়াবে ঘ্রাণ আর সম্ভাবনার বার্তা।