চসিক সচিব আশরাফুলের প্লট বাণিজ্য: সিডিএর অভ্যন্তরে ক্ষমতার অপব্যবহারের নতুন চিত্র
নিজস্ব প্রতিবেদক | সিটিজি পোস্ট
প্রকাশিত হয়েছে: ২৩ নভেম্বর, ২০২৫

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)-তে দায়িত্বকালীন সময়ে প্লট বরাদ্দকে ঘিরে ব্যাপক অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সিটিজি পোস্টের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে, তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকা অবস্থায় নিয়ম ভেঙে নিজের নামে প্লট নেন এবং পরে তা মোটা অংকের বিনিময়ে অন্যজনের কাছে বিক্রি করেন।
সরাসরি সিডিএ'র স্থায়ী কর্মচারী না হয়েও তিনি আওয়ামী আমলে ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে নগরীর অনন্যা ও কল্পলোক আবাসিক এলাকায় প্লট বরাদ্দ আদায় করেন। শুধু নিজের জন্য নয়, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, সিডিএ বোর্ড সদস্য ও কর্মকর্তাদের জন্যও অবৈধভাবে প্লট সুবিধা আদায়ে তিনি ভূমিকা রেখেছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক সূত্র।
ফাঁস হওয়া তালিকা অনুযায়ী, এসব বরাদ্দে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাবেক সাত মন্ত্রী ও আট সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের অন্তত ১৫ নেতা, ১১ সাংবাদিক, ১০ জন সিডিএর বোর্ড সদস্য এবং সিডিএর ৬২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্লট পেয়েছেন। ৪৩টি প্লট পান আওয়ামীপন্থী মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
নিয়ম না মেনেই বরাদ্দ
সিডিএর আবাসিক প্লট বরাদ্দ প্রবিধানমালা ১৯৯৮ অনুযায়ী, প্লট দেওয়ার আগে চারটি জাতীয় দৈনিকে আবেদন আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ বাধ্যতামূলক। কিন্তু ২০০৯, ২০১৩ এবং ২০১৮ সালের তিনটি বরাদ্দ পর্বে এই নিয়ম ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয়। পুরো প্রক্রিয়া চলে গোপনে।
সিডিএর প্লট বরাদ্দ প্রবিধানমালা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় বা সিডিএর আবাসিক প্রকল্পে কোনো আবেদনকারী বা তার পরিবারের সদস্যদের নামে আবাসিক প্লট থাকলে বা অতীতে সিডিএ থেকে প্লটের কোনো ইজারা দেওয়া হলে তাকে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম নেই। এ ক্ষেত্রে এটা মানা হয়নি।
বাজারদরের ছয় ভাগের এক দামে প্লট
অনুসন্ধানে জানা যায়, অনন্যা-কল্পলোক এলাকায় যেখানে কাঠাপ্রতি বাজারদর ছিল ২৫-৩০ লাখ টাকা, সেখানে ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’দের প্লট দেওয়া হয়েছে মাত্র ছয় লাখ টাকায়। বাজারদরের তুলনায় তিন থেকে ছয় গুণ কম দামে এসব বরাদ্দ হয়।
অভিযোগ উঠেছে, আশরাফুল আমিনই এই অনিয়মের মূল কুশীলবদের একজন।
আইন ভেঙে অবৈধ সুবিধা আদায়
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সুবিধা নিজেদের স্বার্থে নেওয়া দুর্নীতি দমন আইন ২০০৪, দণ্ডবিধি ১৮৬০ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর বিভিন্ন ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশেষ করে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা অনুযায়ী, সরকারি পদ ব্যবহার করে নিজে বা অন্য কারও জন্য আর্থিক সুবিধা অর্জন একটি ফৌজদারি অপরাধ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্লট বরাদ্দ ও তা বিক্রি করা, মূল্য কমিয়ে দেওয়া এবং নির্ধারিত নিয়ম গোপনে পাশ কাটিয়ে সুবিধা আদায়- সবকিছুই সরাসরি দুর্নীতির সংজ্ঞায় পড়ে।
অভিযোগ স্বীকার করেছেন নিজেই
এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে চসিক সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন প্লট বরাদ্দের বিষয়টি এড়িয়ে যাননি।
তিনি রোববার (২৩ নভেম্বর) হুয়াটসএপে সিটিজি পোস্টকে বলেন, “আমার নামে প্লট বরাদ্দ হয়েছিল। টাকার অভাবে নিতে পারিনি, তাই অন্য একজনের নামে দিয়ে দিয়েছি।"
তবে অন্যজনের নামে প্লট দিতে কোনো অর্থের লেনদেন হয়েছে কিনা তা জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার ও পরে এড়িয়ে যান।
তবে এই স্বীকারোক্তি আরও বড় প্রশ্ন তোলে- একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে নিয়ম ভেঙে প্লট পেলেন, আর সেই প্লট বিক্রি করার এখতিয়ারই বা তিনি পেলেন কোথায়?
চসিকের সচিবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো এখন সিডিএর পুরনো অনিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাবের নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। তদন্ত এগোলে আরও বড় সিন্ডিকেটের তথ্য বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন নগর সংশ্লিষ্টরা।
সিটিজি পোস্ট/এইচএস/এমএইউ




