যৌন দুর্বলদের টার্গেট করে ব্ল্যাকমেইলিং চক্র, হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক | সিটিজি পোস্ট
প্রকাশিত হয়েছে: ১১ নভেম্বর, ২০২৫

ঘড়ির কাঁটা যখন ১২টার ঘরে, ঠিক তখনই ক্লান্ত শরীরে ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে স্ক্রল করছিলেন তানভীর। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি জ্বলজ্বলে বিজ্ঞাপন “এক ফাইলেই যথেষ্ট, কাজ না করলে মূল্য ফেরত - বিশ্বের ৪০টি দেশে মেডিসিন হোম ডেলিভারি।”
বিজ্ঞাপনটা দেখে থমকে যান তিনি। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে পরিপাটি পোশাক, গলায় স্টেথোস্কোপ। এক ব্যক্তি নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে বলছেন, “এটি বিশ্বের সেরা অর্গানিক পণ্য। বড় বড় ডাক্তাররা সাজেস্ট করেন। বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ গবেষণায় তৈরি হয়েছে এই ওষুধ।”
তানভীর ভাবলেন, হয়তো সত্যিই কোনো সমাধান পাওয়া যাবে। ফেসবুক পেজে দেওয়া ছিল তাদের ফোন নম্বর। যেই ভাবা সেই কাজ। কল দিলেন পেজে দেওয়া ওই নম্বরে।
ফোনের ওপাশের কথা শুনে মনে হচ্ছিল সত্যিই কোনো চিকিৎসক কথা বলছেন। প্রথমে সমস্যা সম্পর্কে জানতে চান, তারপর সহানুভূতির সুরে বলেন, “আপনি দেরি করলে রোগটা আর নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। এখনই ফাইল শুরু করেন।”
এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর নির্দেশনা। প্রথমে ৫ হাজার, পরে ১৫ হাজার, এরপর “অতিরিক্ত রিপোর্ট ফি, ফাইল আপডেট, ওষুধ কুরিয়ার” - এমন নানা অজুহাতে টাকা পাঠাতে থাকেন তানভীর।
কিছুদিন পর হঠাৎ করেই ব্লক, সাথে ফোনটিও বন্ধ। তানভীরের আর বুঝতে দেরি হলো না তিনি শিকার হয়েছেন প্রতারণার।
এমন ঘটনা শুধু তানভীরের সাথেই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার মানুষ এমনভাবে প্রতারিত হয়ে খোয়াচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। যার পেছনে শুধু একটি নয়, রয়েছে বেশ কিছু নাম ‘অর্গানিক হার্ব, অর্গানিক মেনস, অর্গানিক ফুড, ইভেন কেয়ার, দূর্বার অফিসিয়াল, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, আল সুন্নাহ ন্যাচারাল শপ’।
অনলাইনে যৌন উত্তেজক ওষুধের পেজ খুলে এমন বিভিন্ন নামে বুস্টিংয়ের মাধ্যমে প্রবাসী ও সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র।
মূলত তিনটি ধাপে কাজ করে এই প্রতারণা চক্রটি। প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ায় চটকদার বিজ্ঞাপন, পরে ভুয়া ডাক্তার সেজে আস্থা অর্জন, এবং সর্বশেষ ধাপে ধাপে বিভিন্ন কৌশলে টাকা আদায়।
কাউকে দেখানো হয় ভয়, আবার কাউকে করা হয় আশ্বস্ত। আবার বিস্তারিত জানতে চাইলে অতিরিক্ত চাপ দিয়ে বলা হয় “এটা লাইফ থ্রেট ইস্যু, দ্রুত চিকিৎসা না নিলে ঘটতে পারে বড় কোনো বিপদ।”
প্রতারকরা প্রথমে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্ডার নেওয়ার সময় প্রবাসীদের আকামা, পাসপোর্টের ফটোকপি এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত কাগজপত্র চায়। এরপর বলে, “আপনার জন্য কুরিয়ার পার্সেল প্রস্তুত করা হচ্ছে।” কিছুক্ষণ পর জানানো হয় পার্সেল পাঠানো হয়েছে এবং হোয়াটসঅ্যাপে ডিএইচএলের (আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস) মেমো বা পার্সেলের ছবি পাঠানো হয়।
কয়েক ঘণ্টা পর নতুন এক নম্বর থেকে বার্তা আসে, “আপনার পার্সেলে কাস্টম চার্জ ৯৯৯ টাকা ও সার্ভিস চার্জ ৯৯৯ টাকা, মোট ১,৯৯৮ টাকা পরিশোধ করতে হবে।” অফিসিয়াল বিকাশ নম্বর দিয়ে টাকা চাওয়া হয়। টাকা পাঠানোর পর বলে, “আপনার আকামা কার্ডের ছবি পাঠান, পার্সেল স্ক্যানারে পাঠানো হচ্ছে।”
এরপর আবার কল। এবার ফোনের অপর পাশ থেকে ভয় দেখিয়ে বলা হয়, “স্ক্যানারে দেখা গেছে যৌন উত্তেজক ওষুধ রয়েছে, যা ওই দেশে নিষিদ্ধ। আপনার নামে মামলা হয়েছে, দ্রুত টাকা না দিলে কাস্টম পুলিশ লাইভ লোকেশন বের করে আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে।”
এভাবেই ভয়ভীতি দেখিয়ে ধাপে ধাপে টাকা আদায় করা হয়। কেউ না দিলে হুমকি দেওয়া হয় “মামলা বা বিদেশ থেকে ফেরত পাঠানোর।” অনেক প্রবাসী ভয়ে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে বাধ্য হয়েছেন। যার বেশ কিছু প্রমাণাদি সিটিজি পোস্ট কার্যালয়ে সংরক্ষিত আছে।
জানা যায়, সাধারণ মানুষ প্রতারিত হওয়ার পরও লজ্জা কিংবা ভয়ে এসব তথ্য প্রকাশ করে না। ফলে প্রতিবছরই পার পেয়ে যায় এই প্রতারক চক্র।
মূল হোতা সাব্বির ও তার সম্পদের পাহাড়
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চক্রটির মূল হোতা চট্টগ্রামের সাব্বির। তিনি নিজেকে কখনো বন্দরের চাকরিজীবী, কখনো এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেন।
অভিযোগকারীর ভাষ্যমতে, সাব্বিরের ব্যাংক হিসাবে রয়েছে ১৫ কোটি টাকারও বেশি অর্থ, প্রায় ৫০ ভরি স্বর্ণ এবং ১৫ লাখ টাকার আসবাবপত্র। সম্প্রতি তিনি একটি নতুন হুন্ডাই কোম্পানির গাড়িও কিনেছেন।
জানা গেছে, নিজের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও থাকেন ৪০ হাজার টাকার একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, সাব্বিরের মায়ের নাম সাবানা, যার নামে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে লাখ লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন।
চক্রের অন্যান্য সদস্য ও তাদের ভূমিকা
সাব্বিরের সহযোগীদের মধ্যে রয়েছেন মিরসরাইয়ের যুবক সানি সাহা (২২), যিনি চক্রটির ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন এবং সব ধরনের আর্থিক লেনদেন পরিচালনা করেন।
এছাড়াও রয়েছেন সাব্বিরের মামা রুবেল (৪০)। নিজেকে পরিচয় দেন “ডাক্তার নূর আলম” নামে। তিনি রোগীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে প্রতারণার মূল কাজটি চালান। তার ঠিকানা চট্টগ্রাম ঈদগাহ হাজারীদিঘির পাড়।
চক্রের আরেক সদস্য রাজু (৫০) ভুয়া হোমিও সার্টিফিকেট ব্যবহার করে “ডাক্তার মোস্তফা কামাল” নামে প্রতারণা করেন। নোয়াখালীর জসিমও (ছদ্মনাম ডাক্তার জসিম) একইভাবে যুক্ত এই প্রতারণা চক্রে।
ফেসবুক পেজ “অর্গানিক হার্ব”সহ নানা পেজ থেকে বিজ্ঞাপন ও বুস্টিংয়ের কাজটি করেন গালিব। অফিস ও বাসার সব কাজ দেখাশোনা করেন সাব্বিরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী জয় (২৪)।
অর্ডার ও ডেলিভারি পরিচালনায় যুক্ত আছেন নয়াবাজার পানির কল এলাকার জিহাদ (২০), ঈদগাহ হাজারীদিঘিরপাড় মুন্সিপাড়ার সাগর (২৭), আনোয়ারা চৌমুনীর নয়ন (২১), কাজির দেউড়ির রিশাদ (২৮), নোয়াখালীর হৃদয় (২৫), ইমরান (২৩), সিডিএ এলাকার রাইসুল (২৩) এবং ঈদগাহ হাজারীদিঘির মুন্না (২৫)।
এছাড়া বেপারিপাড়ার বিকাশ দোকানদার মামুন তাদের আর্থিক লেনদেনে সহযোগিতা করেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
চক্রের সদস্যরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে ব্যবহার করেন নামে-বেনামে প্রায় কয়েকশ সিম।
শুধু বিজ্ঞাপন আর ফোনকল দিয়ে সাব্বিরের মতো কেউ কীভাবে এত সম্পদ গড়লেন, এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় অনেকেই।
কেন চুপ থাকেন সাধারণ মানুষ
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতারিত হওয়া এক ব্যক্তি বলেন, “ওরা এমনভাবে কথা বলে, মনে হয় সত্যিই রোগ আছে। পরে বুঝি ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়েছে।”
অধিকাংশ ভুক্তভোগী লজ্জায় কারও কাছে বলতে চান না। অনেকে মনে করেন “নিজের ভুল, অভিযোগ করে লাভ কী!” আর এই নীরবতাই চক্রটিকে করছে আরও শক্তিশালী।
হাসান নামের এক ভুক্তভোগী জানান, তার কাছ থেকে প্রতারকরা প্রায় ১২ লাখ টাকা নিয়েছে। একইভাবে অনেককেই বিভিন্ন অজুহাতে ধারাবাহিকভাবে টাকার জন্য চাপ দেওয়া হয়।
সাব্বিরের এই জালচক্র শুধু দেশেই নয়, বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীদের কাছ থেকেও হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। সেই ক্ষেত্রে তাদের কৌশলটা আরেকটু ভিন্ন।
ভুক্তভোগীর বর্ণনা: ধাপে ধাপে টাকার ফাঁদ
দুবাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মানিক। পরিবারের প্রয়োজন আর নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে টাকাপয়সা একটু একটু করে জমাচ্ছিলেন। ব্যক্তিগত রোগজনিত অস্বস্তিতে ওষুধ খুঁজছিলেন তিনি। একদিন হঠাৎ চোখে পড়ে একটি বিজ্ঞাপন। তাতে লেখা ছিল, “চিরস্থায়ীভাবে রোগ সারিয়ে দেবে”। সাথে মোহনীয় প্রতিশ্রুতি, বিশ্বের ৪০টি দেশে হোম ডেলিভারি।
মানিকের মনে আশা জাগে। বিজ্ঞাপনটির নম্বরে কল করেন তিনি।
ফোন ধরে নিজেকে প্রফেসর নূর আলম পরিচয় দেন একজন। কথা বলার ধরন এমন যে মনে হচ্ছিল সত্যিই তিনি নামকরা ডাক্তার।
আশ্চর্যের বিষয়, রোগ সম্পর্কে মানিক কিছু বলার আগেই তিনি বলে ফেললেন, “আপনার সমস্যা বুঝতে পেরেছি। এই চিকিৎসা নিলে আর জীবনে সমস্যা হবে না।”
প্রথমেই কুরিয়ার অর্ডার নিতে বলেন তিনি। মানিক টাকা পাঠানোর পর জানানো হয় ডাক্তারের সিরিয়াল নিশ্চিত।
এরপর শুরু হয় নতুন খেলা। চাওয়া হয় পাসপোর্ট ও আকামা কার্ডের ছবি। পরের ধাপে তারা ডিএইচএল ট্র্যাকিং নম্বর পাঠায়, সাথে পার্সেলের ছবি। এমনভাবে কথা বলে যে সত্যিই যেন বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কিছু পাঠানো হচ্ছে।
কয়েক ঘণ্টা পর আরেকটি নম্বর থেকে ফোন আসে। দাবি করা হয়, “কাস্টম চার্জ এবং সার্ভিস ফি দিতে হবে। ১ হাজার ৯৯৮ টাকা পাঠিয়ে দিন।” মানিক টাকা দেন।
দুই দিন পর আবার ফোন “পার্সেল কাস্টমস স্ক্যানারে ধরা পড়েছে। ভেতরে নিষিদ্ধ যৌন উত্তেজক ওষুধ আছে। কাস্টমস ও পুলিশ বিষয়টি দেখছে।”
ভয় ধরানোর সুরে আরও বলা হয়, “এটা বড় ধরনের অপরাধ হতে পারে। সমস্যা মেটাতে টাকা দিতে হবে। না হলে মামলা হবে।”
এতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন মানিক। বিদেশে থাকা অবস্থায় মামলার ঝুঁকি নিতে চাননি। শুরু হয় টাকার লেনদেন, একবারে নয়, ছোট ছোট অঙ্কে। কখনো প্রসেসিং ফি, কখনো অনুমোদন, কখনো রিলিজ চার্জ।
এভাবে ধাপে ধাপে দেশে থাকা মানিকের ভাইয়ের কাছ থেকে প্রায় ১৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।
টাকা পাওয়ার পর হঠাৎ করেই ব্লক, সাথে ফোনটিও বন্ধ।
মানিক বলেন, “আমি ভয়ে আর তাদের নম্বরে ফোন করি না। কাউকে বলতেও পারি না। নিজেকেই দোষী মনে হয়।”
প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, অর্গানিক হার্বসহ নানান নামে এই প্রতারণা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। অনেক ভুক্তভোগী লজ্জা ও ভয় থেকে অভিযোগ করতে সাহস পান না।
ঘটনার বিস্তারিত জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় এই প্রতারক চক্রের মূল হোতা সাব্বিরসহ আরও বেশ কিছু সদস্যের সাথে। তবে বারবার চেষ্টার পর কথা হয় এই চক্রের অন্যতম সদস্য সাব্বিরের মামা রুবেলের সাথে।
প্রথমে অস্বীকার করলেও কথার এক পর্যায়ে রুবেল সিটিজি পোস্টকে জানান, তারা ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেছেন।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সাধারণ মানুষ আইন সম্পর্কে অনেক কিছুই বোঝে না। তারা ভাবে মামলা করলে লোক জানাজানি হবে এবং তাদের সম্মান ক্ষুণ্ন হবে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে প্রতারকরা।
এই ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে পুলিশের সিআইডি শাখার এসএসপি সালাউদ্দীন আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে আলাদা একটা বিভাগ আছে যারা বেশ গোপনীয়তার সাথে কাজ করে। ভুক্তভোগীর কোনো তথ্য প্রকাশ পায় না। সাধারণ মানুষের উচিত অনলাইনে প্রতারিত হলেই আগে পুলিশকে অবগত করা। তা না হলে দোষীরা বারবার পার পেয়ে যাবে।
সিটিজি পোস্ট/এইচএস




