চট্টগ্রামে অবৈধ ও নকল সিগারেটে সয়লাব, ঝুঁকিতে হাজারো তরুণ ও নিম্ন আয়ের মানুষ

সিটিজি পোস্ট প্রতিবেদক

নিউজ ডেস্ক | সিটিজি পোস্ট

প্রকাশিত হয়েছে: ১৬ নভেম্বর, ২০২৫

চট্টগ্রামে অবৈধ ও নকল সিগারেটে সয়লাব, ঝুঁকিতে হাজারো তরুণ ও নিম্ন আয়ের মানুষ

চট্টগ্রাম বর্তমানে দেশের অবৈধ সিগারেট বাজারের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে রূপ নিয়েছে। বন্দরনগরীর আনোয়ারা উপজেলার দোভাষী বাজারে সরজমিনে দেখা গেছে বাজারজুড়ে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে নানা ব্র্যান্ডের অবৈধ সিগারেট। দোকানগুলোতে টি২০, মার্বেল, পুরবি, এক্সপ্রেস, ওসাকা ও অন্যান্য ব্র্যান্ডের সিগারেট ৪৫ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে যা সরকারনির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যের চেয়ে অনেক কম। এমন চিত্র উঠে এসেছে সম্প্রতি টিবিসের এক প্রতিবেদনে।

দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি খালি প্যাকেট ফেরত দিলে ৫ টাকা ক্যাশব্যাক দেওয়া হয়। কম দামে বিক্রি ও ক্যাশব্যাক সুবিধার কারণে দোকানিদের মধ্যে এসব সিগারেটের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। স্থানীয়দের দাবি, প্রশাসনের নজরদারির অভাবে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

টিবিএস জানায়, চট্টগ্রামের বন্দর, বিমানবন্দর ও সীমান্তবর্তী ভৌগোলিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা চোরাচালান, নকল উৎপাদন ও পাইকারি বিতরণের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। রিয়াজুদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ, চকবাজার ও লালখান বাজার থেকে প্রতিদিন অবৈধ সিগারেট দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হচ্ছে।

বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনসাইড মেট্রিক্স-এর সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, দেশের বাজারে বর্তমানে ১৩.১% সিগারেট অবৈধভাবে প্রবেশ করছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩১% বেশি। প্রতি মাসে ৮৩ কোটি ২০ লাখ শলাকা অবৈধ সিগারেট বাজারে ঢুকছে। এতে সরকারের বছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে।

নকল সিগারেট উৎপাদনের সংখ্যাও বেড়েছে। নকল উৎপাদকরা বৈধ সিগারেটের প্যাকেট থেকে ট্যাক্স স্ট্যাম্প খুলে তা পুনর্ব্যবহার করছে। ফলে কর না দিয়েও বৈধ পণ্যের মতো সিগারেট বাজারে ছাড়তে পারছে তারা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রবণতা জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি। কম দাম হওয়ায় তরুণ ও নিম্ন–আয়ের মানুষ বেশি ঝুঁকছে এসব সিগারেটের দিকে।

টিবিএসের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কসমেটিকস, প্লাস্টিক, আসবাবপত্র কিংবা কমলালেবুর আমদানির ঘোষণা দিয়ে চোরাচালানকারীরা কোটি টাকার সিগারেট দেশে ঢুকাচ্ছে। পাশাপাশি নগরের মহেশখালী, আনোয়ারা, রাউজানসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে নকল সিগারেটের কারখানা। রিয়াজুদ্দিন বাজার এসব অবৈধ পণ্যের প্রধান ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিক্রেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কিছু সরবরাহকারী ফোন করলেই দোকানে সিগারেট পৌঁছে দেয়। পাইকারি দোকানগুলো থেকেও এগুলো সহজেই সংগ্রহ করা যায়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সৈয়দ মাহবুবুল হক বলেন,“অবৈধ সিগারেট শুধু রাজস্ব ক্ষতির কারণ নয়, এটি জনস্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি। এসব সিগারেটে কোনো মান নিয়ন্ত্রণ নেই। বিষয়টি ভ্যাট ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।”

চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার মো. তারেক মাহমুদ জানান, “প্রতিদিন বন্দরে হাজারো কনটেইনার আসে। ভুয়া ঘোষণার আড়ালে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধ পণ্য ঢোকানোর চেষ্টা করে। বেশ কিছু বড় অভিযানে আমরা সেগুলো জব্দ করেছি।” তিনি আরও বলেন, 'কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট, কাস্টমস ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।' 

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের যুগ্ম–পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন,“হাতে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে সব এলাকায় অভিযান চলছে।”

তবে প্রশাসনের তৎপরতা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম হয়ে দেশের বাজারে নিয়মিত প্রবেশ করছে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সিগারেট। গত কয়েক বছরে একের পর এক অভিযানে উঠে এসেছে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ ও আন্তর্জাতিক চোরাচালানচক্রের সক্রিয়তার ইঙ্গিত। 

গত আগস্টে চট্টগ্রাম বন্দরে ধরা পড়ে ১৩৭ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির একটি চালান, যেখানে 'কাগজের চালান' দেখিয়ে মূলত সিগারেট পেপার আমদানি করা হয়েছিল। 

এছাড়া ২৮ জুলাই সীতাকুণ্ডের জোড়ামতল এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রশাসন জব্দ করে ১০ লাখ টাকার এক্সপ্রেস ব্র্যান্ডের লোগোসম্বলিত অবৈধ সিগারেট। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম। 

এসব অভিযানে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার কথাও উঠে আসে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে হালিশহর ও নয়াবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা ও ভ্যাট কর্মকর্তারা বিপুল পরিমাণ বিদেশি সিগারেট পেপার ও অবৈধ সিগারেট স্ট্যাম্প জব্দ করেন। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগের সাবেক কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটন ও তার ভাই আব্দুল মান্নান খোকনের নাম উঠে আসে। 

সূত্র: টিবিএস

সিটিজিপোস্ট/জাউ

ক্যাটাগরি:
চট্টগ্রাম