রেল যেন অবৈধ পণ্য পরিবহনের সেইফ রুট!
চলন্ত ট্রেনে পণ্য তোলার ভিডিও ফাঁস
হাসান সৈকত | সিটিজি পোস্ট
প্রকাশিত হয়েছে: ২ ডিসেম্বর, ২০২৫

রেলের অভ্যন্তরে চোরাচালান সাম্রাজ্যের গুঞ্জন দীর্ঘদিন ধরেই লোকমুখে প্রচলিত থাকলেও এবার তারই প্রমাণ দিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও। চলন্ত অবস্থায় লোকোমাস্টারের (ট্রেনের চালক) হাতে পণ্য তোলা- রেলব্যবস্থার ভেতরে গড়ে ওঠা সংগঠিত সিন্ডিকেটের শেকড় কতটা গভীরে পৌঁছেছে এ যেন তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ননস্টপ চলতে থাকা একটি ট্রেন হঠাৎই অস্বাভাবিকভাবে কমিয়ে দেয় তার গতি। এরপরই দেখা যায় দুইজন ব্যক্তি দুটি বড় বস্তা তুলে দেয় ট্রেনের লোকোমোটিভে (ট্রেনের ইঞ্জিন) থাকা কোনো এক ব্যক্তির হাতে। যা রেল নিরাপত্তার ধারণাকে পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ করে।
রেল সূত্রে জানা যায়, ঘটনাটি গেল ২১ নভেম্বর শশীদল-মন্দবাগ সেকশনের ১৭১/৫ নম্বর পিলার অতিক্রম করা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের।
রেলের ননস্টপ আইকনিক ট্রেন সোনার বাংলাকে থামিয়ে এভাবে পণ্য তোলা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। বরং রেলের জন্য এটি চোরাচালানের মতো বড় অবৈধ সিন্ডিকেটের কালো থাবা।
রেল সংশ্লিষ্টদের মতে, ওই স্পটে ইচ্ছাকৃতভাবে গতি কমিয়ে “ড্রপ-পয়েন্ট” তৈরি করা হয়েছে, যা সাধারণত অবৈধ পণ্য চোরাচালান সিন্ডিকেটগুলো করে থাকে।
রেল সংশ্লিষ্টরা জানান, ২১ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের লোকোমাস্টার ছিলেন মুস্তাফিজ এবং সহকারী লোকোমাস্টার ছিলেন মোশাররফ।
চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে আগে থেকেই চোরাচালান, কুরিয়ার সিন্ডিকেট, লাইনম্যান, গেটম্যান, লোকোমাস্টার সমন্বিত গোপন নেটওয়ার্কের অভিযোগ ছিল বহুদিনের। সেই পুরনো অভিযোগগুলো আবারও সামনে এসেছে এই ভিডিও প্রকাশের পর।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ট্রেনের ইঞ্জিনে অবৈধ পণ্য তোলা চোরাচালান সিন্ডিকেটের একটি পরিচিত কৌশল। এতে চেকপোস্ট, স্ক্যানিং, বগি তল্লাশি- সবকিছুই পাশ কাটিয়ে যায়।
এটি দেখায়, অবৈধ পরিবহন শুধু রেলের বাইরে নয়, বরং ভেতরের দায়িত্বশীল পদেও কতটা স্বাভাবিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের এক কর্মচারী জানান, কিছু রুটে লোকোমাস্টাররাই সিন্ডিকেটের “সেফ হ্যান্ডলার” হিসেবে কাজ করেন। ট্রেনের কোথায় গতি কমবে, কখন পণ্য তোলা হবে, কোন স্পটে লোক দাঁড়াবে- সবকিছু আগেই নির্ধারিত থাকে। এই ঘটনার ভিডিও সেই অভিযোগের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়।
যদিও রেলের অতীতে এমন ঘটনা নতুন নয়। ছাদে পণ্য পরিবহন, বগি ভাড়া দিয়ে চালান পাঠানো, ট্রেন থামিয়ে মাল ওঠানো-নামানো, আরএনবি সদস্যদের ঘুষ নেওয়া- এসব অভিযোগ বছর বছর প্রকাশ হয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। ফলে রেলের ভেতরের সিন্ডিকেট আরও সাহসী হয়ে ওঠে।
রেল সূত্রে জানা যায়, এ ঘটনায় গত ২১ নভেম্বর পূবাইল স্টেশনে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনে যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে। বিষয়টি তদন্তের জন্য রেল কর্তৃপক্ষ প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলীকে আহ্বায়ক করে ডিএসই (সদর), সিআরএনবি (সদর), ডেপুটি সিওপিএস এবং চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ওসি সহ মোট পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।
তবে এই ঘটনায় তদন্ত কতটা এগোবে, কিংবা আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না তা নিয়েও সন্দিহান রেলওয়ের সচেতন মহল। কারণ রেলে এর আগেও বহু ঘটনার তদন্ত কমিটি গঠন হলেও আটকে গেছে তদন্ত রিপোর্ট- ফাইল হয়ে গেছে “বস্তাবন্দী”।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী সাদেকুর রহমান সিটিজি পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তদন্ত চলমান।
তবে একাধিকবার চেষ্টা করেও বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. সুবক্তগীনের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।




