নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত ফর্মুলায় দ্বিমত দেখা দিয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ভিন্নমত ও ভোট প্রক্রিয়ায় অনাগ্রহের কারণে গঠনতন্ত্র সংক্রান্ত আলোচনায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত সংলাপে দলগুলো তাদের অবস্থান তুলে ধরে। এতে দেখা যায়, বিএনপি ও জামায়াত চায় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও তৃতীয় বৃহত্তম দলের প্রতিনিধিকে নিয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়ন দিক। অন্যথায়, আগের নিয়ম অনুযায়ী সাবেক প্রধান বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিতে হবে।
অন্যদিকে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত মডেল অনুসারে, দলগুলো প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে বাছাই কমিটি প্রধান উপদেষ্টাকে নির্ধারণ করবে। কোনো পর্যায়ে একমত না হলে ‘র্যাংক চয়েজ’ বা পছন্দক্রম ভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হবে। এই ভোট প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি ও জামায়াত।
অধিকাংশ দলের সমর্থন র্যাংক চয়েজে
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, জামায়াত ও বিএনপির অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সংলাপে অংশ নেওয়া তিন-চতুর্থাংশ দল ‘র্যাংক চয়েজ’-ভিত্তিক প্রস্তাবনায় একমত হয়েছে। যারা একমত নয়, তারা 'নোট অব ডিসেন্ট' দিয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। তাদেরকে পরবর্তীতে অবস্থান পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বিএনপির প্রস্তাব ও ব্যাখ্যা
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা প্রস্তাব করেছি যাতে ৫ সদস্যের কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়। ’৯১ এবং ’৯৬ সালেও এভাবে কাজ হয়েছে।”
তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি কতটা সম্ভব—সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
জামায়াতের আপত্তি ভোটে
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “ভোট হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি থাকে। হর্স ট্রেডিংয়ের আশঙ্কাও রয়েছে।” তিনি বলেন, ঐকমত্য না হলে বিচার বিভাগ থেকেই প্রধান উপদেষ্টা নেওয়ার পক্ষে তারা।
এনসিপিসহ অন্যদের অবস্থান
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “একই ব্যক্তি যদি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হন, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।” তিনি বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক কাঠামোর বাইরে রাখতে চান এবং প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে র্যাংক চয়েজ প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করার পক্ষে।
সাংবিধানিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করতে কমিশন ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে থাকবে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, তৃতীয় বৃহত্তম দলের প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি এবং প্রধান বিচারপতির মনোনীত একজন আপিল বিভাগের বিচারপতি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিয়োগ এই কাঠামোর বাইরে রাখা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো ও প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের পদ্ধতি নিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্য এখনও অনিশ্চিত। বিএনপি-জামায়াতের ‘সর্বসম্মত কমিটি’ প্রস্তাব এবং এনসিপিসহ অন্যান্য দলের ‘র্যাংক চয়েজ’-ভিত্তিক গঠনের প্রস্তাব—এই দ্বৈত অবস্থানের ফলে সম্ভাব্য সমাধানে বিলম্ব ঘটছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলছে, নির্বাচনী ইশতেহারে দলগুলো তাদের অবস্থান উল্লেখ করতে পারবে এবং নির্বাচনে জয়ী হলে তা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের পথ খোলা থাকবে।