তুমুল সমালোচনায় ভারত সরকার
নয়াদিল্লিতে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় ভারতজুড়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে আফগান দূতাবাসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে, যেখানে কোনো নারী সাংবাদিককে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
একাধিক নারী রিপোর্টার অভিযোগ করেছেন, তাঁরা পোশাকবিধি মেনে উপস্থিত হলেও তাঁদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। এরপর তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং প্রশ্ন তোলেন ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে এমন বৈষম্যমূলক ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে।
এই অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর ভারত সরকার দ্রুত নিজেদের অবস্থান জানায়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, এই সংবাদ সম্মেলনে ‘ভারত সরকারের কোনো ভূমিকা ছিল না’। মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, আফগান মন্ত্রীর সফর উপলক্ষে সাংবাদিকদের তালিকা তৈরি করেছিল মুম্বাইয়ে অবস্থিত আফগান কনস্যুলেট জেনারেল। তারা আরও জানায়, আফগান দূতাবাসের এলাকা ভারতীয় ভূখণ্ডে হলেও তা আন্তর্জাতিক আইনে ভারতের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।
এই ঘটনাকে ঘিরে ভারতের রাজনীতিতে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিরোধী দল কংগ্রেস সরকার ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তীব্র সমালোচনা করেছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, “যখন একটি প্রকাশ্য মঞ্চে নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তখন প্রধানমন্ত্রী দেশের নারীদের জানান দিচ্ছেন যে তিনি তাঁদের পাশে দাঁড়াতে অক্ষম।” তিনি আরও বলেন, “নারীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণের অধিকার রাখেন, আর এমন ঘটনার মুখে সরকারের নীরবতা ‘নারী শক্তি’ স্লোগানের ফাঁপা বাস্তবতা প্রকাশ করে।”
কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করার দাবি জানিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “যে দেশের নারীরা দেশের গর্ব, সেই দেশে সবচেয়ে সক্ষম নারী সাংবাদিকদের অপমান কীভাবে সহ্য করা হলো?”
সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদাম্বরম পুরুষ সাংবাদিকদের নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, “আমি ব্যথিত যে আফগান মন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়া হয়েছে। পুরুষ সাংবাদিকদের উচিত ছিল প্রতিবাদ জানিয়ে ওয়াকআউট করা।”
বিশ্লেষকদের মতে, এই বিতর্কের নেপথ্যে রয়েছে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের নারীবিরোধী কঠোর নীতি। তালেবান নারীদের চাকরি, শিক্ষা ও সামাজিক অংশগ্রহণের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সম্প্রতি আফগান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারী অধিকারসংক্রান্ত বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, পাশাপাশি ‘নারী সমাজবিদ্যা’, ‘মানবাধিকার’, ‘লিঙ্গ ও উন্নয়ন’, ‘আফগান সাংবিধানিক আইন’ এবং ‘বিশ্বায়ন ও উন্নয়ন’-সহ ১৮টি কোর্স বাতিল করা হয়েছে।
এই ঘটনার মধ্যেও মুত্তাকির নয়াদিল্লি সফরকে ভারত-আফগান সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি ভারতে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর জয়শঙ্কর ঘোষণা করেন, ভারত কাবুলে তাদের টেকনিক্যাল মিশনকে দূতাবাসের মর্যাদায় উন্নীত করবে। তিনি আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং উন্নয়নে ভারতের অব্যাহত আগ্রহের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
ভারত ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি আরও ছয়টি নতুন প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছে। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারতের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তালেবান সরকারকে একসময় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার তালেবানের সাথে নতুনভাবে সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। এই কূটনৈতিক পরিবর্তনের পটভূমিতেই নয়াদিল্লির এই বিতর্কিত সংবাদ সম্মেলনটি আলোচনায় এসেছে।
সিটিজিপোস্ট/এমএইচডি