রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও পাথর মেরে নির্মমভাবে এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি বিএনপির অভ্যন্তরেও দেখা দিয়েছে ক্ষোভ ও তীব্র প্রতিক্রিয়া। সরকার জানিয়েছে, এই ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের মাধ্যমে দ্রুত বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, ‘দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন, ২০০২’ এর ধারা ১০ অনুযায়ী মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
নিহত ব্যক্তি যুবদলের কর্মী ও ব্যবসায়ী ছিলেন বলে জানিয়েছে বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদল। শুক্রবার (১১ জুলাই) দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদল যৌথভাবে জানায়, সংগঠন থেকে অভিযুক্ত পাঁচজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে একই সাথে অভিযোগ করা হয় যে, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত তিনজনকে বাদ দিয়ে পুলিশ তিনজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
পুলিশ ও র্যাব এক বার্তায় জানায়, ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার, তবে এটি আলোচনায় আসে শুক্রবার বিকেলে সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে বিবস্ত্র করে লোহার রড, লাঠি ও পাথরের টুকরো দিয়ে নির্মমভাবে আঘাত করা হচ্ছে। কেউ কেউ নিহত ব্যক্তির ওপর দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে বলেও ফুটেজে দেখা যায়।
নিহতের বোনের দায়ের করা এজাহারে বলা হয়, তার ভাই রজনী বোস লেন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ভাঙারি ব্যবসা করতেন। ব্যবসা ও ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে অভিযুক্তরা তাকে নিয়মিত হুমকি দিয়ে আসছিল। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তারা ধারালো দা, লোহার রড, লাঠিসোঁটা ও সিমেন্টের কংক্রিটসহ দোকানে প্রবেশ করে কর্মচারীদের বের করে দেয় এবং টেনে-হিঁচড়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের ভেতর নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধর করে।
বিষয়টি সামনে আসার পর বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারেক রহমানের নাম উল্লেখ করে বিক্ষোভ মিছিল হয় এবং ফেসবুকে প্রতিবাদী স্ট্যাটাস ছড়িয়ে পড়ে। এনসিপি নেতা সারজিস আলম তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, “যেভাবে আওয়ামী লীগের খুনের দায় হাসিনার ওপর পড়ে, ঠিক একইভাবে বিএনপির খুনের দায় তারেক রহমানের ওপরও পড়ে।”
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ ধরনের প্রচার “পরিকল্পিত ও নোংরা রাজনীতির চর্চা” ছাড়া কিছু নয়। তিনি দাবি করেন, দলটির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও বারবার দলকে উদ্দেশ্য করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে সমালোচনা করা হয়।
এদিকে যুবদল সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না অভিযোগ করেছেন, ভিডিও ও সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্টভাবে যাদের দেখা গেছে, তারা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “কারা কেন এ তিনজন আসামিকে বাদ দিয়ে নতুন করে নিরপরাধ তিনজনকে অন্তর্ভুক্ত করলো? বুধবারের ঘটনা প্রচার হলো শুক্রবার—কেন এই বিলম্ব?”
র্যাব মহাপরিচালক একেএম শহিদুর রহমান জানিয়েছেন, ঘটনাটির মূল তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি), তবে র্যাব ছায়া তদন্ত করছে এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিএনপি জেলা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, কারও ‘রেকর্ড খারাপ’ থাকলে আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, “বিএনপি একটি বড় দল, অভিযোগ এলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং সরকারকে সহযোগিতা করছি।”
ঘটনার পাশাপাশি দেশের অন্যত্র সহিংসতার খবরও উঠে আসে। খুলনার দৌলতপুরে যুবদলের সাবেক এক নেতাকে গুলি ও রগ কেটে হত্যা করা হয় এবং একই দিন চাঁদপুরে এক মসজিদের খতিবকে কুপিয়ে আহত করা হয়।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লেখেন, “মিটফোর্ডের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারে সরকার বদ্ধপরিকর। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।”
ঘটনার ভয়াবহতা ও ভিডিওর ছড়িয়ে পড়া নতুন করে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার, প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এখন সবার নজরে।