ছাত্রদের দাবিদাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বৈধ প্রতিষ্ঠান হলো ছাত্র সংসদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে সংক্ষেপে বলা হয় চাকসু। চাকসু শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রশাসনের সঙ্গে সেতুবন্ধনের কাজ করে। কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে চাকসু চালু না থাকায় দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা একচেটিয়াভাবে সুবিধা লাভ করেছে। আর, সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে নানাভাবে অবহেলা ও বৈষমম্যের শিকার হয়। তাদের মতামত, প্রয়োজন, স্বার্থ নানাভাবে উপেক্ষিত হয়ে আসছে। গণ অভ্যুত্থানের পর পর চাকসুর দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলেও এখনো চাকসুর তফসিল ঘোষণা হয়নি।
ছাত্র সংসদ কী?
ছাত্র সংসদ হলো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক প্রতিনিধি পরিষদ। এটি শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত হয় এবং তাদের স্বার্থ, অধিকার ও কল্যাণ রক্ষায় কাজ করে। সাধারণত ছাত্র সংসদ শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কার্যক্রম আয়োজন, এবং প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের মতামত ও চাহিদা পৌঁছে দেওয়ার বৈধ প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নামের কিছু থাকলেও ছাত্র সংসদ গুলো অচলাবস্থায় পড়ে আছে বিগত কয়েক দশক থেকে।বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসিত চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাবি, রাবি, জাবি ও চবিতে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ২০১৯, ১৯৮৯, ১৯৯২ ও ১৯৯০ সালে। ফলে প্রায় তিন দশক ধরে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ ছিল অচল।
সাম্প্রতি ডাকসু, রাকসু ও জাকসুর যথাক্রমে ৯, ১১ ও ১৫ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেও চাকসুর এখনো তফসিল ঘোষণা করেনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৩৫ বছর ধরে চাকসু নেই। চাকসু না থাকায় শিক্ষার্থীদের কোনো বৈধ প্রতিনিধি নেই যেটার মাধ্যমে তারা তাদের দাবিদাওয়া উপস্থাপন করতে পারে। এর ফলে ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীনদলের ছাত্রনেতারা একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং বিরোধী বা অন্যান্য ছাত্রসংগঠন প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় তাদের স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে।
চাকসু থাকলে আসন বণ্টন, শাটল ট্রেন ও বাসের সময়সূচি, খাবারের মান, লাইব্রেরি ও ল্যাব উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা—এসব সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের ওপর প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হতো। চাকসু ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া ও অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রম আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রতিভা ও নেতৃত্ব বিকাশেও সহায়তা করে।
গত কয়েক দশকে চাকসু না থাকার কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উল্লেখযোগ্য জাতীয় বা প্রভাবশালী নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। অতীতে চাকসু থেকে মাহমুদুর রহমান মান্না, এসএম ফজলুল হক, মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী, জসিম উদ্দিন ও নাজিম উদ্দিনের মতো নেতৃবৃন্দ উঠে এসেছিলেন। এরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং জাতীয় রাজনীতি এবং সামাজিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
অন্যদিকে, দীর্ঘ সময় ধরে চাকসু না থাকায় বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রনেতারা এই প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত। তারা কেবল দলীয় রাজনীতির ওপর নির্ভর করে উঠে আসেন, যেখানে সংগঠিত কর্মসূচি, নীতি প্রণয়ন বা প্রশাসনের সঙ্গে বৈধ আলোচনার বদলে প্রভাব বিস্তার, সাংগঠনিক আধিপত্য ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বর্তমানে চাকসু কার্যত শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার প্ল্যাটফর্ম না হয়ে ভাতঘর ও কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলে শিক্ষার্থীরা মতামত দেয়। অনেকে একে ব্যঙ্গ করে ‘জোবরা কমিউনিটি হাউজ’ বলে থাকেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে। গত ৫৯ বছরে ৫৯টি চাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৬ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে এবং সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর ছাত্রনেতা ফারুকুজ্জামান খুন হওয়ার পর চাকসুর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্ব গঠনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকেছে।
সিটিজি পোস্ট/ এসএইচএস