দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, কমিটি বিলুপ্তি ও সাংগঠনিক অস্থিরতার পর নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি। গেল ৩০ জুলাই রাউজানে সংঘর্ষের ঘটনায় কেন্দ্রীয় নেতা রুহুল কবির রিজভীর স্বক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে বিলুপ্ত করা হয় চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। একই সঙ্গে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাইস চেয়ারম্যান পদও স্থগিত করেছে কেন্দ্র।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির রাজনীতি বরাবরই ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে ভরপুর। পূর্বের দুটি আহ্বায়ক কমিটিও কাটাতে পারেনি সাংগঠনিক স্থবিরতা। দলীয় কার্যালয় দখল, নেতৃত্বে টানাপোড়েন ও গ্রুপিংয়ের কারণে কমিটি বিলুপ্তি পর্যন্ত গড়ায়। এতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকে।
এবার আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখন নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের নেতৃত্ব নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে তিনটি বিষয়ের ওপর- গ্রহণযোগ্যতা, ত্যাগ এবং ঐক্য।
যারা তৃণমূলে গ্রহণযোগ্য, দীর্ঘদিন দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং বিভাজনের পরিবর্তে ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠতে পারবেন, তারাই আলোচনায় এগিয়ে আছেন।
মূল কমিটি নাকি আবারও আহ্বায়ক?
আগে উত্তর জেলা বিএনপির দুই কমিটিই ছিল আহ্বায়ক। এবার পূর্ণাঙ্গ মূল কমিটি হবে নাকি আবারও আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হবে- এ নিয়ে দলীয় অঙ্গনে জোরালো আলোচনা চলছে। অনেক নেতাই মনে করছেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছাড়া সাংগঠনিক অস্থিরতা কাটানো সম্ভব নয়। তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পরিস্থিতি অনুকূলে না হলে আবারও আহ্বায়ক কমিটির পথ বেছে নিতে পারেন বলে জানিয়েছেন পদপ্রার্থী আলোচিত নেতারা।
আলোচনায় কারা?
দলীয় মহলে আলোচনায় আছেন বেশ কয়েকজন আলোচিত ও ত্যাগী নেতা। কেউ কেউ আহ্বায়ক বা সদস্য সচিব পদে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বাড়িয়েছেন যোগাযোগও। ফলে নতুন কমিটি ঘোষণাকে ঘিরে উত্তর জেলা বিএনপির রাজনীতিতে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
সভাপতি পদপ্রার্থী হিসেবে আলোচনার শীর্ষ রয়েছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব ও সাবেক আহ্বায়ক লায়ন আসলাম চৌধুরী। তিনি এক সময়ের প্রভাবশালী যুগ্ম-মহাসচিব ও উত্তর জেলা বিএনপির শক্তিশালী নেতা। ২০০০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তার নেতৃত্বে সংগঠন ছিল ঐক্যবদ্ধ।
তবে আওয়ামী আমলে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন দীর্ঘ ৮ বছর। ২০২৪ সালে মুক্তির পর আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন তিনি। এছাড়াও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তার প্রভাব রয়ে গেছে আগের মতোই।
এছাড়া পদপ্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন আরেক নেতা এস এম ফজলুল হক। তিনি চাকসুর সাবেক ভিপি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার পাশাপাশি বিজিএমই এর সাবেক সহ-সভাপতি হিসেবেও বেশ পরিচিত। এছাড়াও তিনি একাধারে সংগঠক, উদ্যোক্তা ও প্রভাবশালী শিল্পপতি।
এদিকে ফটিকছড়ি উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কর্ণেল আজিমউল্লাহ বাহারও পিছিয়ে নেই এই দৌড়ে। তিনি বলেন, দায়িত্ব না দিলে যোগ্যতা পরখ করা যাবে না। উত্তর জেলা বিএনপির প্রতিটা নেতাই বেশ যোগ্য। এগের কমিটিতে যারা ছিলেন তারাও যোগ্যতাই কম ছিলেন না।
তিনি আরো বলেন, আমি আমার কথা বলবো না, দল যাকে যোগ্য মনে করবে তার হাতেই নেতৃত্ব ভার দিবেন।
সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী-
এই পদে এগিয়ে আছেন রাংগুনিয়ার উপজেলা বিএনপির তিনবারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (২০০৮–২০২১) প্রফেসর মোহাম্মদ মহসিন।চট্টগ্রাম উত্তর জেলার তৃণমূল রাজনীতিতে রয়েছে তার ব্যপক জনপ্রিয়তা।
নতুন কমিটিতে পদপ্রাপ্তির গুঞ্জণ নিয়ে জানতে চাইলে প্রফেসর মোহাম্মদ মহসিন সিটিজি পোস্টকে বলেন,আমি বলছি না আমাকেই পদ দিতে হবে- দল যা চায় যেভাবে চায়, তাই হবে। দলের নেতা-কর্মী সকলেই বেশ ত্যাগ স্বীকার করেছে। এখন দলের উঠতি মুহূর্তে দলের উপর চাপ প্রয়োগ করে কোন কিছু করা ঠিক হবে না। দল যাকে যোগ্য মনে করবে তাকেই দিবে।
তিনি আরো বলেন, আমি শুরু থেকেই দলের সাথে ছিলাম- পদ পেলে হয়তো দলের জন্য কাজ করার সুযোগ বেড়ে যাবে, তবে পদ না পেলেও আমি সব সময় দলের জন্য করে যাব।
এছাড়াও এই পদের জন্য আলোচনায় রয়েছেন উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সরওয়ার আলমগীর এবং রাংগুনিয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবু আহমেদ হাসনাত।
শিল্পপতি থেকে রাজনীতির মাঠে আসা সরওয়ার আলমগীর ছিলেন উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক।
সরওয়ার আলমগীর বলেন, পদের আকাংঙ্খা সবার মধ্যেই আছে- তবে দল সবার উপরে। আমি আগেই থেকেই দলের সাথে ছিলাম আর ভবিষ্যতেই থাকবো। কাকে কোন পদ দেওয়া হবে বা কে যোগ্য তা কেন্দ্র নির্ধারণ করবে।
এদিকে '"মূল কমিটি হবে নাকি আহ্বায়ক কমিটি" এমন প্রশ্নের জবাবে রাংগুনিয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবু আহমেদ হাসনাত সিটিজি পোস্টকে বলেন, পরিস্থিতি অনুকূল না হলে আবারও আহ্বায়ক কমিটির পথ বেছে নিতে পারেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এটা একটা প্রসিডিউর- আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর নির্বাচনের মাধ্যমে মূল কমিটি গঠিত হয়।
পদ নিয়ে চাওয়া-পাওয়া সর্ম্পকে জানতে চাইলে আবু আহমেদ হাসনাত বলেন, সব কিছুই কেন্দ্রের হাতে, কেন্দ্র যোগ্য মনে করলে দিবে আর না দিলে মনে করবো আমার কোথাও না কোথাও ভুল আছে।
কেন্দ্রীয় তদন্ত ও সিদ্ধান্ত-
নতুন নেতৃত্ব বাছাইয়ের জন্য আজিজুল বারী হেলালের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক কমিটি মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করছে বলে জানা গেছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামিম বলেন, উত্তর জেলায় বিএনপির জনসমর্থন ব্যাপক। কিন্তু দীর্ঘদিনের কোন্দল ও সাংগঠনিক দুর্বলতা কেন্দ্রকে ভাবাচ্ছে। এখন প্রয়োজন একজন বলিষ্ঠ ও ঐক্যবদ্ধকারী নেতা। দল তৃণমূলের প্রত্যাশার দিকেই তাকিয়ে আছে।
শেষ পর্যন্ত কে হবেন উত্তর জেলা বিএনপির নতুন আহ্বায়ক তা নিয়ে এখনো রহস্য রয়ে গেছে।
তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, নতুন নেতৃত্ব পুরনো কোন্দল কাটাতে পারলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি আবারও শক্ত অবস্থানে ফিরবে।