বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ হেভি মেটাল ব্যান্ড ব্ল্যাক সাবাথ-এর প্রখ্যাত ভোকালিস্ট ও ‘প্রিন্স অব ডার্কনেস’ খ্যাত ওজি ওসবার্ন চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সকালে ৭৬ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের ঘিরে নিঃশ্বাসের শেষ মুহূর্তগুলো কাটিয়েছেন ভালোবাসার আবহে। যদিও মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ জানানো হয়নি, তবে দীর্ঘ সময় ধরেই নানান জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই “ব্যাক টু দ্য বিগিনিং” শিরোনামে বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওসবার্নের বিদায়ী কনসার্ট। দীর্ঘ ছয় বছর শারীরিক অসুস্থতায় ভোগার পর সেই মঞ্চে নিজের পুরোনো ব্যান্ড সদস্যদের সাথে গান গেয়েছিলেন তিনি। কনসার্টে নিজের আবেগ উজাড় করে দিয়ে বলেছিলেন, “আমি ছয় বছর ধরে পড়ে ছিলাম, আপনারা জানেন না আমি এখন কেমন অনুভব করছি। হৃদয়ের গভীর থেকে ধন্যবাদ জানাই।”
এই একই কনসার্টের এক আবেগঘন মুহূর্তে ব্যাকস্টেজে ওজি ওসবার্ন স্বাক্ষী ছিলেন মেয়ের এক বিশেষ সিদ্ধান্তে। তার মেয়ে কেলি ওসবার্ন বাগদান সম্পন্ন করেন আমেরিকান হেভি মেটাল ব্যান্ড স্লিপনট-এর সদস্য সিড উইলসনের সাথে। পরিবারের উপস্থিতিতে এই বাগদানের মুহূর্ত সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেন কেলি, যেখানে দেখা যায়, বাবা ওজি গর্বিত মুখে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। এই জুটির একটি পুত্র সন্তানও রয়েছে, যার নাম সিডনি।
জন মাইকেল ওসবার্ন নামে ১৯৪৮ সালে বার্মিংহামের অ্যাস্টনে জন্মগ্রহণ করা ওজি ওসবার্ন বেড়ে উঠেছেন কঠিন বাস্তবতার মাঝে। যৌবনে নানা বিপর্যয় ও অপরাধের মধ্য দিয়ে গিয়েও তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন একজন রক আইকন হিসেবে। ব্ল্যাক সাবাথ ব্যান্ডের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া তার কণ্ঠের গা ছমছমে সুর হেভি মেটাল ঘরানাকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। ‘প্যারানয়েড’, ‘ওয়ার পিগস’, ‘আয়রন ম্যান’ এই সব গান আজও ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৯৭৯ সালে মাদকাসক্তির কারণে ব্যান্ড থেকে বাদ পড়ার পরও থেমে থাকেননি ওজি। ‘ব্লিজার্ড অব ওজি’ দিয়ে শুরু হয় তার সফল একক ক্যারিয়ার, যা ২০২০ পর্যন্ত চলমান ছিল। এলটন জন, পোস্ট মালোন থেকে শুরু করে ট্র্যাভিস স্কটের সাথে গান গেয়ে প্রজন্মকে অবাক করেছেন তিনি। ২০০৩ সালে নিজের মেয়ে কেলির সাথে করা ‘চেইঞ্জেস’ গানটি পৌঁছে যায় চার্টের শীর্ষে।
তবে কেবল সংগীত নয়, তার জীবন ছিল চরম বিতর্কিত। ১৯৮২ সালে লাইভ কনসার্টে একটি মৃত বাদুড়ের মাথা কামড়ে ধরার ঘটনা, অথবা ১৯৮১ সালে রেকর্ড কোম্পানির সভায় দুটো কবুতরের মাথা কামড়ে ফেলা এইসব নিয়ে নানা বিতর্ক পেরিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। নিজের স্ত্রী শ্যারনকে একবার মদ্যপ অবস্থায় হত্যার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। যদিও পরে তারা আবার একত্রিত হন এবং শ্যারন-ওজির দাম্পত্যে জন্ম নেয় একটি সফল ব্র্যান্ড, যার মাঝে অন্যতম ছিল ‘ওজি ফেস্ট’ ও রিয়েলিটি শো ‘দ্য ওসবার্নস’।
তার জীবনে ছিল শারীরিক ও মানসিক দুর্দশার দীর্ঘ অধ্যায়। ২০০৩ সালে কোয়াড বাইক দুর্ঘটনায় ঘাড় ও হাড় ভেঙে গিয়েছিল, এমনকি থেমে গিয়েছিল নিঃশ্বাসও। ২০২০ সালে তিনি ঘোষণা দেন পারকিনসন’স রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা। এরপর একাধিক অস্ত্রোপচার, থেরাপি ও আধুনিক চিকিৎসা নিয়েও আর সুস্থ হতে পারেননি।
শেষ জীবনে বিষণ্নতায় ভোগা ওসবার্নকে উৎসাহ দিতে তার স্ত্রী আয়োজন করেন “ব্যাক টু দ্য বিগিনিং” কনসার্ট। সেই কনসার্টে ব্যাট-আকৃতির সিংহাসনে বসেই পারফর্ম করেন তিনি, যেখানে উপস্থিত ছিলেন মেটালিকা, স্লেয়ার ও গানস এন’ রোজেস-এর মতো কিংবদন্তি ব্যান্ড। এক পর্যায়ে তিনি দর্শকদের উদ্দেশে বলেন, “আমি আয়রন ম্যান, চল দাও পাগলামি!”
তার মৃত্যুর পর এলটন জনসহ বিশ্ব সংগীতজগতের বহু তারকা শোক প্রকাশ করেছেন। এলটন তাকে স্মরণ করে বলেন, “তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত কিংবদন্তি, রক দেবতাদের মাঝে একজন স্থায়ী নাম। ওজির মত মজার মানুষ খুব কমই দেখেছি আমি। তাকে খুব মিস করব।”
কিংবদন্তির মৃত্যু যেনো জীবন্ত আইকনের মহাকাব্যিক প্রস্থান। শব্দ, সুর, ব্যথা আর ভালোবাসা মিশিয়ে যে বিদায়ের গান তিনি গেয়েছেন, তা চিরকাল থেকে যাবে অনুরাগীদের হৃদয়ে এবং রক সঙ্গীতের ইতিহাসে।
সিটিজিপোস্ট/এমএইচডি