ডাকসু, রাকসু ও জাকসুর তফসিল ঘোষণা করা হলেও এখনো ঘোষণা আসেনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের তফসিল।
২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের পর দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত কেবল ডাকসু নির্বাচনে থেমে যায়। ওই নির্বাচনে ডাকসুর ভিপি হন নূর হোসেন ও সমাজসেবা সম্পাদক হন আখতার হোসেন। তবে এরপর ২০১৯ সালের পর আর কোনো ডাকসু নির্বাচন হয়নি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে, সামনে আসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রশ্ন। গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা ছাত্রদের একাংশ এই ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসিত চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাবি, রাবি, জাবি ও চবিতে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ২০১৯, ১৯৮৯, ১৯৯২ ও ১৯৯০ সালে। ফলে প্রায় তিন দশক ধরে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ ছিল অচল। এ সময়ে ক্যাম্পাসগুলো মূলত চলেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের ইশারায়। গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না বললেই চলে ।
দীর্ঘ তিন দশক পর তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তফসিল ঘোষণা হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এখনো চাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেনি। অথচ চাকসু নির্বাচনের দাবিতে সবচেয়ে সরব ছিল চবির শিক্ষার্থীরাই।
চবি শিক্ষার্থীরা গত ৫ জানুয়ারি নয় দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। সেই দাবির প্রথমেই ছিল চাকসু নির্বাচন। এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনগুলোর আলোচনায় চাকসু গঠনতন্ত্র সংস্কার বিষয়ে কথা হয়। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে খসড়া দেওয়ার কথা থাকলেও তা আসে ২০ মে। শিক্ষার্থীরা একে প্রশাসনের ‘স্পষ্ট গড়িমসি’ হিসেবে দেখেন।
ডাকসু, রাকসু ও জাকসুর যথাক্রমে ৯, ১১ ও ১৫ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেও চাকসুর এখনো তফসিল ঘোষণা করেনি।
চাকসুর তফসিল ঘোষণা না হওয়ায় ৩০ জুলাই শিক্ষার্থীরা চাকসু দাবিতে বিক্ষোভ করেন এবং স্লোগান দেন— "এক দুই তিন চার / চাকসু আমাদের অধিকার / রুখে দেওয়ার সাধ্য কার", "৩৫ বছরের বঞ্চনা / মানি না, মানব না", "ডাকসু হলো, রাকসু হলো / চাকসু কেন থেমে গেল?"
১ আগস্ট অনুষ্ঠিত ৫৫৯তম সিন্ডিকেট সভায় চাকসুর নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়।
নতুন গঠনতন্ত্রে মোট ২৮টি পদ রাখা হয়েছে, যার মধ্যে ১২টি নতুন। নির্বাহী সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে কমিয়ে ৫ করা হয়েছে। ভোটার ও প্রার্থিতার সর্বোচ্চ বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ বছর।
তবে দেরিতে গঠনতন্ত্র অনুমোদন ও এখনো তফসিল না হওয়ায় চবি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। নতুন গঠনতন্ত্র ও তফসিল নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তাদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের মতামত উপেক্ষা করে একতরফাভাবে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস চবি শাখার সভাপতি সাকিব মাহমুদ রুমী বলেন, “আমাদের সবচেয়ে প্রধান দাবি ছিল—শুধু অনার্স ও মাস্টার্সের নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই প্রার্থী হতে পারবে। এমফিল ও পিএইচডির শিক্ষার্থীদের চাকসুর বাইরে রাখার ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত ছিল। উপ-উপাচার্য কামাল উদ্দিন আহমেদ স্যার আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের মতামত অনুযায়ী গঠনতন্ত্র হবে, কিন্তু তা মানা হয়নি।”
নারী শিক্ষার্থী সুমাইয়া সিকদার বলেন, “দীর্ঘদিন পর চাকসু নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ থাকলেও, শতাংশের হিসেবে নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ খুবই কম। এর জন্য মূলত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকাই দায়ী।”
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির চবি শাখার সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, “আমরা ২৪ দফা দাবির মধ্যে চাকসুর দাবি রেখেছিলাম এবং ভেবেছিলাম নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নিয়েই তফসিল ঘোষণা করবে। কিন্তু প্রায় এক বছর পরও তা হয়নি। নতুন গঠনতন্ত্র একতরফাভাবে ৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রণয়ন করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের মতামত আমলে নেওয়া হয়নি।”
চবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, “এই গঠনতন্ত্রে ছাত্রদলের আপত্তি রয়েছে। এটি বিশেষ একটি সংগঠনকে সুবিধা দিতে তৈরি করা হয়েছে। এমফিল-পিএইচডির শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে অধিকাংশ সংগঠন বিরোধিতা করলেও প্রশাসন তা উপেক্ষা করেছে। এছাড়া ৩০ বছর বয়সসীমাও বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে কৌশলগতভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে।”
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান বলেন, “জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখন প্রশাসনের উচিত দ্রুত নির্বাচন দেওয়া। তবে শিক্ষার্থীদের মতামত না নিয়ে প্রণীত গঠনতন্ত্রের মাধ্যমে কতটা অধিকার নিশ্চিত হবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।”
স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসির চবি শাখার আহ্বায়ক মাঈন উদ্দিন আরাফ বলেন, “স্বৈরাচার এরশাদ পতনের পর গণতন্ত্রের আশা জাগলেও, পরবর্তী সরকারগুলো শিক্ষার্থীদের কণ্ঠরোধ করেছে। ৩৫ বছর ধরে চাকসু হয়নি। বর্তমানে চাকসু হয়ে গেছে ‘ভাতঘর’, ‘কমিউনিটি সেন্টার’। আমরা একে বলি ‘জোবরা কমিউনিটি হাউজ’। প্রশাসন শিক্ষার্থীদের শুধু ‘মুলা’ দেখায়, গঠনতন্ত্রে শিক্ষার্থীদের মতামত নেই, বরং বানানো হয়েছে প্রশাসনের ইচ্ছামতো।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে। এখন পর্যন্ত মাত্র ৬ বার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে এবং সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর ছাত্রনেতা ফারুকুজ্জামান খুন হওয়ার পর চাকসুর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্ব গঠনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকেছে।
অনেকের মতে, এখন সময় এসেছে চাকসু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ছাত্রদের অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার।
সিটিজি পোস্ট/ জাউ