বন্দর নগরী চট্টগ্রামে কোলাহল পেরিয়ে যখন সন্ধ্যা নামে, বহদ্দারহাটের গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশ ও খড় দিয়ে তৈরি ছোট্ট চায়ের দোকানটি যেন সবার মন টানে। দুর্দান্ত সব কারুকাজ আর ডিজাইনে তৈরি এই কুটিরে চায়ের স্বাদ নিতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন চা প্রেমীরা। তরুণ উদ্যোক্তা তকিরের এই শখের চায়ের দোকানে সুরঞ্জন স্পেশাল, বর্ণ চা, মালাই কথা সহ আরও হরেক রকমের চা পাওয়া যায়।
বাঁশ ও ছনের তৈরি ছোট্ট একটি কুটির। বাঁ পাশে ঝুলানো কুলা-মাটির হাড়ি, ডানে কিছু বই আর উপরের ছাউনিটা খড় দিয়ে ছাওয়া। গায়ে অদ্ভুত সব আর্টওয়ার্ক আর দৃষ্টিনন্দন লাইটিং। কুলার গায়ে লেখা আছে বিচিত্র সব চায়ের নাম। রাতের আঁধারে আপন আলোয় উদ্ভাসিত বাঁশের তৈরি এই ছোট্ট কুটির যেন গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে এনেছে শহরের বুকে।
ছোট্ট এই কুটিরের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সুরঞ্জন’। পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর তকির স্বল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করেছেন এই শখের চায়ের দোকানটি। তিন মাস আগে মাত্র দেড় লাখ টাকার পুঁজিতে শুরু করা এই চায়ের দোকান থেকে তার দৈনিক আয় এক হাজার টাকার বেশি।
নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার ফিনলে সাউথ সিটির দক্ষিণ পাড় ঘেঁষে যাওয়া ছোট্ট গলিতেই ‘সুরঞ্জন’ এর অবস্থান। প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দোকানটি খুলা থাকে। রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বন্ধ থাকে।
সুরঞ্জনে আছে তেজিকা, দুগ্ধ ছোয়া, দুগ্ধ রস, মালাই কথা, উষ্ণলহরী, বর্ণ চা ও সুরঞ্জন স্পেশাল। চায়ের নামগুলো যেমন বাহারি তেমনি স্বাদেও অনন্য।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চায়ের দোকানটির সামনে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভীড়। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে চায়ের স্বাদ নিচ্ছেন তারা। চায়ের সাথে জমেছে আড্ডাও। কেউবা পরিবার নিয়ে, কেউবা আসেন একা আবার অনেকে বন্ধু বান্ধব নিয়ে দল বেঁধে সুরঞ্জনে আসেন চা খেতে। বিশেষ করে, ছুটির দিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে।
রাহাত্তারপুল থেকে সোহান তাঁর বন্ধুদের নিয়ে এসেছেন চা খেতে। তিনি সিটিজিপোস্টকে বলেন, “এখানে চায়ের স্বাদটা একদম আলাদা। ‘দুগ্ধ রস’ আমি প্রথমবার খেলাম, একদম মন জয় করে নিল। আমাদের রাহাত্তারপুলে অনেক দোকান আছে, কিন্তু সুরঞ্জনের মতো এমন পরিবেশ খুব কমই দেখি। বন্ধুরা মিলে চা খেতে এখানে প্রায়ই চলে আসি।”
বহদ্দারহাটের বাসিন্দা রায়হান জানান, “প্রতিদিন অফিস শেষে এক কাপ ‘বর্ণ চা’ না খেলে মনে হয় দিনটা অপূর্ণ থেকে যায়। শুধু চা নয়, এখানে যে একটুকরো প্রশান্তি পাওয়া যায়। সেটাই আমাকে বারবার টানে।”
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী জুবায়ের বলেন, “সুরঞ্জনের ‘মালাই চা’ আমার সবচেয়ে পছন্দের। কড়া, কিন্তু ব্যালেন্সড। পরীক্ষার আগের রাতে বা ক্লান্ত বিকেলে এটা যেন আমার এনার্জি বুস্টার।”
বান্ধবীর সাথে আসা স্থানীয় বাসিন্দা মীম জানান, “আমাদের বান্ধবী মহলে সুরঞ্জন এখন ট্রেন্ড। শুধু চা খেতে নয়, আমরা এখানে এসে ছবি তুলি, গল্প করি, আর নতুন চায়ের স্বাদ নিয়ে রিভিউ দিই সোশ্যাল মিডিয়ায়।”
সারাদিন চা বানিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন দোকানের মালিক মোহাম্মদ তকি উসমান। মাত্র ২৫ বছর বয়সি উদ্যমী এই তরুণের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায়।
তকি তাঁর স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে সিটিজিপোস্টকে বলেন, “ছোটবেলা থেকেই নিজের উদ্যোগে কিছু করার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন ও শখ থেকেই ‘সুরঞ্জন’ নামের এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু। শুরুটা ছোট পরিসরে হলেও ভবিষ্যতে এটি বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় পরিকল্পনা রয়েছে। প্রাথমিক লক্ষ্য হলো চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় চেইন সিস্টেমে একাধিক শাখা প্রতিষ্ঠা করা, যাতে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ফান্ড সংগ্রহ করে একটি পূর্ণাঙ্গ রেস্টুরেন্ট চালু করার লক্ষ্য রয়েছে।”
নিজেদের পড়াশোনা আর চাকরির পাশাপাশি বেশিরভাগ সময় তকিকে কাজে সাহায্য করেন তার দুই বন্ধু তাসমির ও ওবায়দুল।
তারা কেন বন্ধুকে সহযোগিতা করেন জানতে চাইলে তাসমির বলেন, “তকি হয়তো আমার আত্মীয় না, কিন্তু আমার কাছে উনি নিজের ভাইয়ের মতো। ওনার “সুরঞ্জন” দোকানে আমি যেভাবে পারি সাহায্য করি, কারণ ওনার পাশে থাকা আমার কাছে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। উনি একা সব কিছু সামলায়, অনেক পরিশ্রম করে। আমি পাশে থাকলে যদি একটু সাহায্য হয়, সেটাই বড় কথা।”
ওবায়দুল জানালেন, “তকি আমার বন্ধু, আবার কাজিনও। ছোটবেলা থেকেই আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো। ও যখন “সুরঞ্জন” দোকানটা শুরু করলো, প্রায় তখন থেকেই আমি ওকে সাহায্য করি। আসলে ও একা সব কিছু সামলাতে গিয়ে কষ্ট পায়। পাশে থাকলে ওর কাজ কিছুটা হলেও হালকা হয় এই ভাবনা থেকেই সাহায্য করি।”
দোকানে কাজ করাটা তারা উপভোগ করে জানিয়ে বলেন, “অনেক রকম মানুষ আসে, কথা বলে, গল্প হয়। কারো মুখে চায়ের চুমুকে হাসি দেখলে নিজেরও ভালো লাগে। এখানে অনেক কিছু শেখা যায়। মানুষ চিনতে পারি, সম্পর্ক বুঝতে পারি ও অভিজ্ঞতা অর্জন হয়। তকির পাশে থাকা আমার জন্য কোনো দায়িত্ব না, বরং এক ধরনের শান্তি।”