তখন গভীর রাত, সীমান্তের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে অজানা শব্দ। দূরে কোথাও বজ্রপাত হচ্ছে, ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামছে সাম্বার আকাশে। যেন এক অদৃশ্য উত্তেজনায় মুড়ে আছে জম্মু-কাশ্মির সীমান্ত থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরের এই শান্তশিষ্ট জেলা। পাহারায় আছে ভারতীয় সেনারা। তাদের দায়িত্ব দেশের গোপন তথ্য, সীমান্তের নিরাপত্তা আর জনগণের আস্থা রক্ষা করা।
কিন্তু এতো নিরাপত্তার মাঝেও হঠাৎই একদিন জন্ম নিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এক বিশ্বাসঘাতকতার গল্প, যা ‘সাম্বা স্ক্যান্ডাল’ নামেই বহুল অলোচিত।
যার শুরুটা হয়েছিল সাধারণ এক ছোট্ট লোভ থেকে।
১৬৮তম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের সদস্য সারওয়ান দাস। মাস শেষে যে বেতন-ভাতা পান, তা দিয়ে সংসার চালানো তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। দিন দিন বেড়ে চলা দারিদ্র্য আর সীমাহীন লোভ তাকে অস্থির করে তুলছিল। অবশেষে এক রাতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য এবার বেছে নিবেন ঝুঁকিপূর্ণ পথ।
সেই রাতেই প্রথমবার তিনি সীমান্ত টপকে প্রবেশ করলেন পাকিস্তানে। ভাবলেন, চোরাকারবারিদের সাথে সামান্য যোগাযোগ করলেই হাতে আসবে কিছু টাকা। কিন্তু ভাগ্য তখন তার জন্য লিখে রেখেছিল অন্য খেলা।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস- পাকিস্তানের শিয়ালকোট বাসস্ট্যান্ড হয়ে দেশে ফেরার পথে ক্লান্ত হয়ে এক কোণে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। সেই ঘুমেই ভয়ংকর মোড়ে রূপ নিল তার জীবন। পাকিস্তানি এক পুলিশ কর্মকর্তা তার কাছে ভারতীয় সেনার পরিচয়পত্র পেয়ে গ্রেপ্তার করলেন তাকে।
এরপর একে একে শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। তাকে বলা হলো “তোমার পরিচয় সবার সামনে ফাঁস করে দেব। ”
আতঙ্কিত সারওয়ান দাস বুঝতে পারলেন, জীবন বাঁচাতে হলে তাকে অন্য পথ বেছে নিতে হবে। তখনই পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল।
লোভের দাসত্বে আবদ্ধ সারওয়ান এবার রাজি হয়ে গেলেন। সীমান্ত ঘাঁটির মানচিত্র, কর্মকর্তাদের নাম, গোপন তথ্য- সবই তিনি একে একে হস্তান্তর করতে শুরু করলেন।
একা নন, পেলেন নতুন সঙ্গী- সারওয়ান দাস বুঝলেন একা কাজ করলে ধরা পড়তে পারেন। তাই তিনি টাকার লোভ দেখিয়ে নিজের সহকর্মী আয়া সিংকেও এই অন্ধকার পথে টেনে আনলেন। দুজন মিলে পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করলেন। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর চলতে থাকল এই বিশ্বাসঘাতকতার খেলা।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের পাল্টা খেলা-
তিন বছর ধরে চলতে থাকা এই বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি আঁচ করতে শুরু করে ভারতীয় সেনারা। বিশ্বাসঘাতকদের ধরতে ভারতীয় সেনারা ১৯৭৫ সালে তৈরি করে একটি চতুর ফাঁদ। তাদেরই একজনকে পাকিস্তানি এজেন্ট সাজিয়ে পাঠানো হলো সারওয়ান দাস ও আয়া সিংয়ের কাছে। আর তখনই বেরিয়ে আসে সত্য।
সারওয়ান দাস ও আয়া সিংকে গ্রেপ্তার করে আনা হলো ভারতীয় মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা শুধু নিজেদের অপরাধই স্বীকার করলেন না, আরও ৫০ জনের বেশি সেনা কর্মকর্তার নামও ফাঁস করলেন।
মিথ্যা স্বীকারোক্তি আর চরম মূল্য-
নির্দয় টর্চার সেলের ভেতর অনেক নাম উঠে এলেও, পরবর্তীতে যাদের অনেকেই নির্দোষ প্রমাণিত হন।
কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। কোর্ট মার্শাল, চাকরিচ্যুতি আর সমাজের চোখে কলঙ্কিত হওয়ার দাগ তাদের জীবনকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দিল।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের একেকজনকে বানিয়ে তুলল “মীর জাফর”। অথচ প্রকৃত খলনায়ক ছিলেন সারওয়ান দাস ও আয়া সিং।
তাদের এক মুহূর্তের লোভ, একটি ভুল সিদ্ধান্ত শুধু নিজেদের জীবনই নয়, আরও অর্ধশতাধিক সহকর্মীর জীবন ধ্বংস করে দিল।
‘সাম্বা স্ক্যান্ডাল’ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে শুধু একটি ঘটনা নয়, বরং এক অমোচনীয় কলঙ্ক। এই কাহিনি প্রমাণ করে, যখন একজন সেনাসদস্য নিজের দেশকে ভুলে ব্যক্তিগত স্বার্থকে বড় করে তোলে, তখন তার পতনের ধাক্কা গোটা জাতিকে কাঁপিয়ে দেয়।
প্রতিটি সেনা কেবল একজন যোদ্ধাই নন, জাতির আস্থা। আর সেই আস্থা ভেঙে গেলে বিশ্বাসঘাতকতা কখনোই ক্ষমার যোগ্য হয় না।