ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর পর রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের লক্ষ্যে প্রণীত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই সনদ ২০২৫’-এর খসড়া প্রকাশ করেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে এই সনদ চূড়ান্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, ৩৬ দিনের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে। আন্দোলনের সময় এবং পরে নিহত হন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ, আহত হন বিশ হাজারের অধিক। সরকার পতনের পর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ভারতে পালিয়ে যান।
পতনের তিন দিন পর, ৮ আগস্ট, ইউনুস সরকারের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়। তবে এই সরকারের কার্যক্রম নিয়ে শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলো ও গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারিরা কম সমালোচনা করলেও সময় গড়ানোর সাথে সমালোচনাও বাড়ছে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশ একদিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি—এই দুই সঙ্কটে পড়ে। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়, জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও অসন্তোষ থেকেই যায়।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর, সরকার ছয়টি পৃথক সংস্কার কমিশন গঠন করে। সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন। এই ছয়টি কমিশন ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ সালে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে, এই ছয়টি কমিশনের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করা হয়। কমিশনের সভাপতি হন প্রধান উপদেষ্টা, সহ-সভাপতি করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রিয়াজকে, সদস্য হিসেবে থাকেন নির্বাচন, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য। কমিশনের দায়িত্ব ছিল—সংবিধান, প্রশাসন, বিচার ও নির্বাচনী সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপের সুপারিশ প্রণয়ন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের কার্যক্রম শুরু করে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। প্রথম ধাপের বৈঠক শেষ হয় মে মাসে। এরপর দ্বিতীয় ধাপের বৈঠক চলছে, যা শেষ হবে ৩১ জুলাই। মোট ৩৫টির বেশি রাজনৈতিক দল ও জোট এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে এবং ২০টি মূল বিষয়ে আলোচনা করার জন্য মোট ৪৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে চাইলেও এখনো সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়নি। দ্বিতীয় দফার আলোচনার ২০টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৮টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। এর মধ্যেই গত সোমবার একটি খসড়া সনদ রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে—নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর দুই বছরের মধ্যে সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে রাজনৈতিক দলগুলো।
প্রস্তাবিত জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আপত্তি জানিয়েছে। তাদের মূল দাবি হলো, সনদে থাকা সংস্কার প্রস্তাবগুলো যেন আইনি কাঠামোর আওতায় বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
জুলাই সনদের খসড়া হাতে পাওয়ার নানান রাজনৈতিক দল পক্ষে-বিপক্ষে তাদের অবস্থান তুলে ধরে মতামত ব্যক্ত করেন।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, "খসড়াটি এখনো দলীয়ভাবে পর্যালোচনার পর্যায়ে রয়েছে। তাঁদের দাবি, খসড়ায় মৌলিক প্রতিটি সংস্কার প্রস্তাব স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়, তাহলে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে—তাঁরা এই খসড়ায় স্বাক্ষর করবেন কি না। তিনি আরও জানান, খসড়াকে আইনি ভিত্তি দিতে হলে ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ (আইনি আদেশ) গঠন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসা কোনো সরকার এই সংস্কারগুলো এড়িয়ে যেতে না পারে। পাশাপাশি আখতার হোসেন বলেন, এনসিপি শুরু থেকেই গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সংবিধান পুনর্লিখনের পক্ষে। তাঁর মতে, এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংবিধানে সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে।"
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জুলাই সনদের খসড়া আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়া একটি দুর্বল উপস্থাপনা হিসেবে বিবেচনা করে। দলটির মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ বলেন, খসড়ায় প্রধান দাবি—আইনি মর্যাদা ও বাধ্যবাধকতা—সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ নেই। এছাড়া, পতিত ফ্যাসিবাদের মূল হোতা হিসেবে শেখ হাসিনার নাম খসড়ায় নেই, যা তারা সমালোচনা করেছে। তাই তাদের মতে, খসড়ার কোনো বাস্তব তাৎপর্য নেই।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, "জুলাই সনদের কিছু অংশ বিপজ্জনক। সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে আইনি কাঠামো না থাকলে পুরো প্রক্রিয়া অনিশ্চয়তায় পড়বে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাঁর প্রস্তাব, অধ্যাদেশ জারি করে কাঠামো তৈরি করে পরে সংসদে অনুমোদন বা গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অনুমোদন নেওয়া যেতে পারে।
তিনি আরও জানান, "জামায়াত নিজস্ব একটি সংশোধিত খসড়া কমিশনের কাছে জমা দেবে।"
বিএনপি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের খসড়ার সঙ্গে মোটামুটি একমত রয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, "তারা খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত অঙ্গীকারগুলো মেনে নিচ্ছেন। তবে শব্দ ও বাক্য গঠনের কিছু বিষয় নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ রয়েছে, যা তারা কমিশনকে জানাবেন।"
জুলাই সনদের গুরুত্ব সম্পর্কে চট্রগ্রাম মহানগর ছাত্র ফেডারেশন নেতা শওকত ওসমান তৌকির সিটিজিপোস্টকে বলেন, "জুলাই অভ্যুত্থানের একবছর হওয়ার পরও জুলাই সনদ না হওয়া টা খুবই হতশাজনক।সব রাজনৈতিক দলের একমতের ভিত্তিতে দ্রুত জুলাই সনদ করে ফেলা উচিত।"
তিনি আরও বলেন, "এটা একটা শঙ্কার ব্যাপার যে আমরা এখনো ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারছি না। এ ব্যাপারে আমাদের মত হলো যেসকল ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারছে না সেগুলো তারা তাদের নির্বাচনী ইশতিহারে উল্লেখ করে করবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে জয়লাভ করে সরকারে আসার একবছরে মধ্যে বাস্তবায়ন করবে।"
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা রিফাত ইসলাম সুহৃদ বলেন, "জুলাই সনদ এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে পরবর্তীতে যদি আওয়ামী লীগ ব্যাক করে তখন তারা বলবে জুলাই আন্দোলন ছিল একটা রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলন, বাইরের পরাশক্তির মাধ্যমে যেটা সফল করা হয়।"
তিনি আরও বলেন, "ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে আমাদের দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফসল জুলাই সনদ সংবিধানে সংযুক্ত করা উচিত। জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর সাংঘর্ষিক বক্তব্য সম্পর্কে তিনি বলেন, এনসিপির প্রস্তাব বিএনপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে মেনে নিতে হলে এই ঐকমত্য কমিশনের করার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। তাদের মতো করে জুলাই সনদ না হলে এনসিপির জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার ঘোষণা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিপরীত।"
জাতীয় যুবশক্তির সংগঠক তানজিদ রহমান বলেন, "অন্যান্য রাজনৈতিক দল না চাইলেও জুলাই সনদের আগে জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে। এনিসিপি জুলাই গণ অভ্যুত্থানের দল হিসেবে জুলাই ঘোষণাপত্র উপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন এনসিপি চায় জুলাইয়ের ঘোষপত্রের আগে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও বিচার করতে হবে। বিচারের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হবে আওয়ামী লীগ একটা সন্ত্রাসী দল।"
স্টুডেন্টস এলায়েন্স ফর ডেমোক্রেসির (স্যাড) আহ্বায়ক তৌহিদ আবদুল্লাহ বলেন, "আমাদের দুইটা জিনিস ক্লিয়ার থাকা উচিত। আমরা কী করবো, কেন করবো। জুলাই অভ্যুত্থান যেহেতু পরিকল্পিতভাবে ঘোষণা দিয়ে হয়নি সেহেতু এখন ঘোষণাপত্রের চেয়ে সনদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। গণ অভ্যুত্থান পরিকল্পিতভাবে হয় না। এটা হাঠাৎ হয়ে যায়। বাকশালি শোষনের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামের ডকুমেন্টেশন প্রয়োজন।জুলাই সনদ প্রণয়নে কালক্ষেপণ আসলেই দুঃখজনক। এখানে আরেকটা লক্ষ্যনীয় হলো ইন্টেরিম সনদ নিয়ে শুধু রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলছে। সনদ কোনো গোপন নথি নয়, উচিত ছিলো বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক থেকে মতামত নেওয়া। আরেকটা বিষয় হলো, সনদে রাজনৈতিক দলের সংস্কারের ইস্যুটি এড্রেস করা জরুরি। তিনি আরও বলেন নাহিদ সরকারে ছিল, তিনি সেখানে থাকতে জুলাই ঘোষণাপত্র দেয়নি কেন? সংস্কার একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, ইন্টেরিমের উচিত যতটুকু সংস্কার করতে পারে করে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে দেওয়া।"
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী জুলাই সনদ ঘোষণার দাবি উঠেছিল গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্রদের পক্ষ থেকে। উদ্দেশ্যে ছিল জুলাই অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া। অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর পর অনেক বৈঠক ও আলোচনার শেষে যখন সনদের খসড়া প্রকাশ করা হলো তখন এই খসড়ার প্রতি নারাজি প্রকাশ করলো গণ অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল এনসিপি, জামাত ও আরও কয়েকটি দল। এমতাবস্থায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
সিটিজি পোস্ট/ জাউ
৩১ জুলাই, ২০২৫
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দাবি করেছেন, গত বছরের আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জাতীয় সরকার ও নতুন সংবিধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি ওই প্রস্তাবে সম্মত হননি।বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে নাহিদ ইসলাম এ দাবি করেন। তি...
৩১ জুলাই, ২০২৫
৩১ জুলাই, ২০২৫
৩১ জুলাই, ২০২৫
৩১ জুলাই, ২০২৫
৩০ জুলাই, ২০২৫
৩১ জুলাই, ২০২৫
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দাবি করেছেন, গত বছরের আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জাতীয় সরকার ও নতুন সংবিধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি ওই প্রস্তাবে সম্মত হননি।ব...