ফুটবল, বিশ্বজুড়ে এর জনপ্রিয়তা সর্বজনীন। পদ্মার পাড় থেকে এভারেস্টের চূড়া পর্যন্ত,ফুটবলপ্রেমী মানুষের অভাব নেই। বাঙালির কাছে ফুটবল কেবল একটি খেলা নয়, এটি এক গভীর আবেগ। একসময় বিশ্বকাপ ফুটবল ঘিরে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও উড়তো নানা দেশের পতাকা, প্রিয় দলের জার্সি পরে সমর্থন জানানো ছিল নিত্যদিনের চিত্র। নিজ দেশের বিশ্বকাপ মঞ্চে না থাকলেও বিদেশি দলের প্রতি এমন ভালোবাসা একমাত্র বাঙালির পক্ষেই সম্ভব।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশে ক্রিকেট ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৯৭ সালে আকরাম খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক আইসিসি ট্রফি জয় দেশের ক্রিকেটকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যায়। সাকিব, তামিম, মাশরাফি, মুশফিক, রিয়াদদের মতো তারকাদের আগমনে ক্রিকেট দেশের মানুষের কাছে এক বিশেষ স্থান করে নেয়। অন্যদিকে, ঘরোয়া ফুটবলের জৌলুস কমতে থাকে, গ্যালারি ফাঁকা হতে শুরু করে।
বর্তমানে, ক্রিকেট কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তারকাসংকট, ধারাবাহিকতার অভাব এবং মাঠের বাইরের বিতর্কে ক্রিকেট এখন সমালোচিত হচ্ছে। ঠিক এই সময়ে, দেশের ফুটবলে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা হামজা চৌধুরী, ইতালির লিগে ফাহামেদুল ইসলাম এবং কানাডায় খেলা সামিত সোমদের মতো প্রবাসী ফুটবলারদের আগমনে ফুটবলের গ্যালারি আবারও দর্শকে ভরে উঠছে। টিকিটের জন্য মানুষের হাহাকার আর বাফুফের সামনে সমর্থকদের অবস্থান কর্মসূচি – এসব দৃশ্য এখন নিয়মিত।
ক্রিকেটের সোনালি যুগের কান্ডারি আকরাম খান ফুটবলের এই পুনরুত্থানে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, ফুটবল ও ক্রিকেট উভয়ই দেশের পতাকা বহন করে এবং ফুটবলের এই জাগরণ ধরে রাখা উচিত। ডেইলি সানের স্পোর্টস এডিটর আতিফ আজম ফুটবল ও ক্রিকেটের মধ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখেন না, বরং মনে করেন তারা একসাথে চলতে পারে। তার মতে, ফুটবলের এই জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হলে এশিয়ান কাপের মূল পর্বে খেলতে হবে, কারণ সফলতা ছাড়া জনপ্রিয়তা ধরে রাখা কঠিন।
অন্যদিকে, সকাল-সন্ধ্যার ক্রীড়া সম্পাদক সনৎ বাবলা অতীতের উদাহরণ টেনে সতর্ক করেছেন। ২০০৩ সালে সাফ শিরোপা জয়ের পর ফুটবলের জনপ্রিয়তা সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণে টেকেনি। তিনি মনে করেন, প্রবাসী ফুটবলাররা শক্তি যোগালেও ভবিষ্যতের জন্য স্থানীয় খেলোয়াড়দের উন্নয়ন জরুরি। ফুটবল বিশ্লেষক আহমেদ শায়েক মনে করেন, দেশের মানুষ সাফল্যপ্রেমী এবং ফুটবলের এই আগ্রহ নতুন কমিটির 'বিগিনারস লাক'ও হতে পারে। এই আগ্রহ ধরে রাখতে হলে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স এবং মাঠের প্রতি মনোযোগ অপরিহার্য। তিনি সতর্ক করেন, মাঠের বাইরের আলোচনা যদি ফুটবলে প্রাধান্য পায়, তবে উন্নয়ন থমকে যাবে।
বর্তমানে, নতুন কমিটি ও বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্বে মাঠের খেলা গুরুত্ব পাচ্ছে, যা একটি ইতিবাচক দিক। তবে এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ফুটবল তার হারানো আবেগ ফিরে পাচ্ছে, ঘরের আনন্দের উৎস হয়ে উঠছে আবারও। ক্রিকেট তার স্থানেই থাকবে, তবে ফুটবলের এই জাগরণ যেন ক্ষণিকের উন্মাদনা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। মাঠের খেলাই আসল, আর একে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠুক নতুন দিনের বাংলাদেশের ফুটবল।