প্রধানমন্ত্রী যেহেতু স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে সবুজ সংকেত দিয়েছেন, সেই হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে যাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের।
আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। এই প্রেক্ষাপটে, চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে ইতোমধ্যে মনোনয়ন-বঞ্চিত ৯ প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন।
দলের মনোনয়ন-বঞ্চিত হয়ে নিজ সমর্থকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে কয়েকজন বিদ্রোহী প্রার্থী সরাসরি জানিয়েছেন, তাঁরা নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করবেন। জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তাঁরা সংসদ সদস্য পদে জয়ী হবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে অথচ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহাবুবুর রহমান রুহেল।
কিন্তু, মনোনয়ন-বঞ্চিত হওয়ার পরপরই আসনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। তিনি টিবিএসকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘকাল ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছি। এইবার প্রত্যাশা করেছিলাম, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে। কিন্তু, নেত্রীর বিবেচনায় আমি মনোনয়ন পাইনি। তবে আমার সমথর্কেরা চাপ সৃষ্টি করেছেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করবো।’
চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি আসনে বর্তমানে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য খাদিতাজুল আনোয়ারা সনি নৌকা প্রতীক পেয়েছেন। ওই আসনে আগে মহাজোটভুক্ত প্রার্থী ছিলেন বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী।
তবে এই আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম আবু তৈয়ব। তিনি বলেন, সংসদ সদস্য পদে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
চট্টগ্রাম ৩ (সন্দ্বীপ) আসনে নৌকার মাঝি হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা। তাঁর সঙ্গে এই আসন থেকে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন ১০ জন। তাদের দুজন নিশ্চিত করেছেন, এই আসন থেকে মনোনয়ন-বঞ্চিতদের একজন অবশ্যই স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন। তবে কে হবেন, সেই বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলছে। তাদের মধ্যে মতৈক্য হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবেন এবং তারা ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে জয় অর্জনের জন্য কাজ করবেন।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুন্ড) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য দিদারুল আলমকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আল মামুন। কিন্তু, আসনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আ. লীগের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ উপ-কমিটির সদস্য লায়ন মোহাম্মদ এমরান।
চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে নৌকা পেয়েছেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম (এম এ সালাম)। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য রয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। যিনি ইতোমতো রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে ফরম সংগ্রহ করেছেন।
আবার, একই আসনে নতুন ভাগ’ বসানোর জন্য ফরম নিয়েছেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। ফলে এই আসনে শেষ পর্যন্ত নৌকা থাকবে, নাকি শরীক দলের মধ্যে জাতীয় পার্টি বা কল্যাণ পার্টিকে ছাড় দেওয়া হবে– সেটি স্পষ্ট নয়।
চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য নোমান আল মাহমুদ। কিন্তু, ওই আসনে আওয়ামী লীগের শরীক দল বিএনএফ’র প্রেসিডেন্ট এস এম আবুল কালাম ইতোমধ্যেই রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ফরম সংগ্রহ করেছেন। তিনি মহাজোটগত আসন ভাগাভাগির চাপ তৈরি করলে– সেটা হবে নোমান আল মাহমুদের জন্য অস্বস্তিকর।
আবার একই আসনে আওয়ামী লীগের আরেক শক্ত মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন আবদুছ ছালাম। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক এই চেয়ারম্যান ওই আসন থেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন কি না– তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি। তবে তার সমর্থকদের ভাষ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ নেত্রীর সবুজ সংকেত থাকায় তিনি এই বিষয়ে ভাবছেন। দু’একদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
এ ছাড়া, মহানগরীর অপর দুই আসন চট্টগ্রাম-১০ (হালিশহর-ডবলমুরিং) এবং চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর) আসনে নৌকার বিপক্ষে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী বিদ্রোহী হচ্ছেন কি না তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। এসব আসনে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনের মতো শক্তিশালী রাজনীতিবিদ রয়েছেন, যারা মনোনয়ন প্রত্যাশাও করেছিলেন।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পটিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে সদ্য পদত্যাগী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী।
কিন্তু, মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পরপরই নাগরিক কমিটির ব্যানারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সামশুল হক চৌধুরী। এই আসন থেকে ২০০৮ সাল থেকে তিন দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সামশুল।
চট্টগ্রাম-১৪ আসনে তৃতীয়বারের মতো নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে গেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তবে নজরুল ইসলামের পথের কাঁটা হতে যাচ্ছেন চন্দনাইশ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল জব্বার। তিনি বলেন, আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইনশাল্লাহ, ভোটারদের ভালোবাসায় আমি নির্বাচিত হবো।’
চট্টগ্রাম-১৫ আসন থেকে তৃতীয় দফায় নৌকার টিকিট পেয়েছেন আবু রেজা মো. নিজামউদ্দিন নদভী। কিন্তু, এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব। মনোনয়ন না পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আমিন কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছেন আবদুল মোতালেব।
একইভাবে চট্টগ্রাম-১৬ আসনে নৌকার টিকেট পেয়েছেন অস্ত্র উঁচিয়ে মিছিল করে আলোচনা-সমালোচনায় আসা মোস্তাফিজুর রহমান। সেখানে শক্তিশালী মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শিল্পপতি মুজিবুর রহমান (সিআইপি)। তিনি বলেন, আমি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবো।
তবে কিছুটা আওয়ামী লীগ কিছুটা স্বস্তিতে আছে চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান), চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) এবং চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে। এই চার আসনে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে না -এটা প্রায় নিশ্চিত।