এই আসনটি ঐতিহাসিকভাবে জাতীয়তাবাদী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোর শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তবে কোতোয়ালিতে সংখ্যালঘু ভোটারের আধিক্যের কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগও অতীতে এখানে সুবিধা পেয়েছে। এবার সংখ্যালঘু ভোট কার দিকে যাবে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

পুরো বাকলিয়া ও কোতোয়ালি থানা এবং আংশিক চকবাজার নিয়ে গঠিত হলেও বাকলিয়ার ভোটাররাই মূলত জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত। সর্বশেষ নির্বাচনে এ আসনের ভোটার সংখ্যা ছিল চার লাখ নয় হাজার ৫৭৬ জন।

ভোটার তালিকা হালনাগাদ শেষ হওয়ায় চট্টগ্রামে নতুন ভোটার সংখ্যা শীঘ্রই জানা যাবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

১৯৯১ সালে এ আসনে আওয়ামী লীগের এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে বিজয়ী হন সদ্য প্রয়াত বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের এম এ মান্নান জয়ী হন, পরে ২০০১ সালে নোমান আসনটি পুনরুদ্ধার করেন।

২০০৮ সালে আসনের সীমানা পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই নতুন প্রার্থী দেয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আসেন নুরুল ইসলাম বিএসসি এবং বিএনপি থেকে আসেন শামসুল আলম। দুই ব্যবসায়ীর লড়াইয়ে জয়ী হন নুরুল ইসলাম বিএসসি।

২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিলে জিয়াউদ্দিন বাবলু সংসদ সদস্য হন। এরপর ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী আমলে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি ভোটাধিকার। তাই আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনের ভোটারদের মধ্যে আবারো ভোট দেওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) এই আসনে প্রার্থী দেবে বলে জানা গেছে।

বিএনপি

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় এ আসনে বিএনপির সম্ভাবনা বেড়েছে। এতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। মনোনয়ন পেতে দৌঁড়ে আছেন স্থানীয় শিল্পপতি ও বিএনপি নেতা শামসুল আলম, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, সাবেক মেয়র ও মন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন এবং নগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর।

২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়ে আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলামের কাছে পরাজিত হন শামসুল আলম। ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণে তিনি ঋণ খেলাপি হন এবং ২০১৮ সালের পর থেকে দলের কর্মকাণ্ডেও অনিয়মিত ছিলেন।

তবে ৫ আগস্টের পর তিনি বাকলিয়া ও কোতোয়ালিতে বেশ সক্রিয়ভাবে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরছেন। বৃহত্তর বাকলিয়ার স্থানীয় হিসেবে তার একটি প্রভাব রয়েছে। যদি ঋণ খেলাপির কারণে তিনি প্রার্থী হতে না পারেন, তবে তার পুত্র শোয়েব রিয়াদকে মনোনয়ন দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে, যদিও তিনি তেমন পরিচিত নন।

বর্তমান মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন একজন শক্তিশালী প্রার্থী। তবে মেয়র পদে থেকে তিনি নির্বাচন করবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। বাকলিয়া ও কোতোয়ালির বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনগুলো মূলত তার অনুসারীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বিএনপির যেই প্রার্থী হোক না কেন, শাহাদাত হোসেনের বলয় মাঠে বড় প্রভাব ফেলবে।

সাবেক মেয়র ও মন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীনের পোস্টার আসনজুড়ে দেখা গেলেও বয়স ও স্বাস্থ্যগত কারণে তার সক্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল, যদিও বর্তমানে তিনি আবারও মাঠে নেমেছেন।

নগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর কোতোয়ালি এলাকার স্থানীয় এবং সংগঠনিকভাবে বেশ শক্তিশালী হলেও বাকলিয়াতে তার অবস্থান তুলনামূলক কিছুটা দুর্বল।

এ ছাড়া একটি গুঞ্জন আছে, জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার তামিম ইকবাল এ আসনে বিএনপির হয়ে নির্বাচন করতে পারেন। এমনটা হলে নির্বাচনী সমীকরণ বদলে যাবে।

জামায়াত

এ আসনে অতীতে জোট ভিত্তিক নির্বাচন করায় বরবারই জামায়াত বিএনপি প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে আসছে। তবে এবারের হিসেব ভিন্ন। যার ফলে একক প্রার্থী ঘোষনা দিয়ে মাঠা গোছানো শুরু করেছে বাংলাদেশের বৃহত্তম ধর্মভিত্তিক এই রাজনৈতিক দল।

চট্টগ্রাম-৯ আসনের বাকলিয়া এলাকা জামায়াত-শিবিরের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম নগর উত্তরের শিবিরের প্রধান কার্যালয় এখানে অবস্থিত। আসনের চকবাজারেও জামায়াত-শিবিরের ভালো প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম কলেজ, মহসীন কলেজ এবং বিপুল সংখ্যক কোচিং সেন্টার রয়েছে দলটির সমর্থকদের পরিচালনায়।

বাকলিয়ার ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডেও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদেও জামায়াতের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন, যা তাদের ভিত্তি শক্তিশালী হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

এবার জামায়াত আসনটিতে প্রথমবারের মতো দলটির নগর সাংগঠনিক সম্পাদক ও চিকিৎসক ডা. একেএম ফজলুল হককে প্রার্থী করার ঘোষণা দিয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম শহরে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে পরিচিত মুখ।

তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, পার্কভিউ হাসপাতাল এবং মা-শিশু জেনারেল হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। এছাড়া জামালখানে অবস্থিত চিটাগাং আইডিয়াল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের চেয়ারম্যানও তিনি।

ডা. ফজলুল হক ইতোমধ্যে কোতোয়ালি ও বাকলিয়ায় গণসংযোগ শুরু করেছেন এবং পোস্টারও দেখা গেছে। তবে সংখ্যালঘু ভোটারদের টানার ক্ষেত্রে জামায়াত কিছুটা চাপে থাকবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এছাড়া ধর্মীয় আক্বিদাগত কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বা সুন্নি অংশের ভোট পেতেও কষ্ট হবে দলটির প্রার্থীর।

এনসিপি

জুলাই বিপ্লবের পর গঠিত নতুন রাজনৈতিক শক্তি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)ও এই আসনে প্রার্থী দিতে যাচ্ছে।

দলটির সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক ও দক্ষিণাঞ্চল-পার্বত্য অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক ইমন সৈয়দ এবং দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক জুবাইরুল হাসান আরিফ প্রার্থী হতে পারেন।

যদিও এ দুজনই অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং এখনো স্থানীয়ভাবে তেমন পরিচিত নন। তবে এনসিপির পক্ষ থেকে চমক হিসেবে শক্তিশালী স্থানীয় কোনো প্রার্থীও দেওয়া হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।

এবি পার্টি ও অন্যান্য ছোট দল

আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) পক্ষ থেকে ছিদ্দিকুর রহমানকে প্রার্থী হিসেবে দেখা যাচ্ছে। তিনিও নতুন মুখ এবং সাধারণ ভোটারদের কাছে এখনও তেমন পরিচিত নন। দলটি এবার ঈগল প্রতীক নিয়ে প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।

এছাড়া গণঅধিকার পরিষদসহ আরও কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দলও এ আসনে প্রার্থী দিতে পারে বলে জানা গেছে।

সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম-৯ আসনে একাধিক প্রার্থী নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা, জামায়াতের প্রথাগত আধিপত্য এবং এনসিপির নতুন শক্তির উপস্থিতিতে আসন্ন নির্বাচনে হতে পারে ত্রিমুখী লড়াই।