পেশাদার রেসলিং জগতের অন্যতম প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় মুখ হাল্ক হোগান আর নেই। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ক্লিয়ারওয়াটার নগরীতে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। প্রকৃত নাম টেরি জিন বোলিয়া হলেও, ‘হাল্ক হোগান’ নামেই তিনি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ছিলেন।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) ওয়ার্ল্ড রেসলিং এন্টারটেইনমেন্ট (ডব্লুডব্লুই) এক বিবৃতিতে হোগানের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে জানায়, “ডব্লুডব্লুই হল অব ফেমার হাল্ক হোগানের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। পপ কালচারের অন্যতম পরিচিত মুখ হোগান ১৯৮০-এর দশকে ডব্লুডব্লুইকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর পরিবার, বন্ধু ও অসংখ্য ভক্তদের প্রতি ডব্লুডব্লুই সমবেদনা জানাচ্ছে।”
ক্লিয়ারওয়াটার পুলিশ জানায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার খবরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস দ্রুত হোগানের বাসায় পৌঁছায়। ফায়ার ও রেসকিউ টিম তাঁকে মর্টন প্লান্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর সময় তিনি পরিবার-পরিজনের পাশে ছিলেন।
‘হাল্ক হোগান’ নামে বিশ্বজুড়ে খ্যাত এই তারকার জন্ম ১৯৫৩ সালের ১১ আগস্ট জর্জিয়ার অগাস্টা নগরীতে। তবে বড় হয়েছেন ফ্লোরিডার ট্যাম্পা নগরীতে। সংগীত, বেসবল ও ফিটনেসের প্রতি ঝোঁক থাকলেও শুরুটা হয়েছিল রক ব্যান্ডের বেস গিটারিস্ট হিসেবে। পরে ভাগ্য তাঁকে নিয়ে যায় রেসলিং রিংয়ে।
‘হাল্ক’ উপাধিটি আসে তাঁর বিশাল দেহী চেহারার কারণে একবার লু ফেরিগনোর পাশে দাঁড়িয়ে তাকে আরও বলিষ্ঠ দেখায়, যেখান থেকে আসে ‘হাল্ক’। আর ‘হোগান’ নামটি যোগ করেন ডব্লুডব্লুইর প্রতিষ্ঠাতা ভিন্স ম্যাকমোহন সিনিয়র, যাতে আইরিশ ধাঁচের আবেদন তৈরি হয়।
দীর্ঘ সময় হোগান এই নামটি শুধু স্টেজ হিসেবে ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে আইনি ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ‘হাল্ক হোগান’ নামটি ব্যবহারের অনুমোদন পান।
শুধু রেসলিং রিং নয়, হাল্ক হোগান হয়ে উঠেছিলেন ৮০ ও ৯০-এর দশকের পপ কালচার আইকন। সিনেমা, টিভি শো, ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল থেকে শুরু করে ভিডিও গেম সবখানেই ছিল ‘হাল্কাম্যানিয়া’র আধিপত্য।
১৯৮২ সালের বিখ্যাত সিনেমা ‘রকি থ্রি’-তে থান্ডারলিপস চরিত্রে তার উপস্থিতি তাকে মূলধারার খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয়। এরপর তিনি ১৯৮৪ সালে দি আয়রন শেখকে হারিয়ে ডব্লুডব্লুই চ্যাম্পিয়ন হন এবং পরবর্তী চার বছর সেই খেতাব ধরে রাখেন।
তার বিখ্যাত সংলাপ ‘Whatcha gonna do?’ কিংবা বাহু সম্পর্কে তার গর্ব ‘২৪ ইঞ্চি পাইথন’ তাঁকে দর্শকের মনে অমর করে তোলে। “সে ইউর প্রেয়ারস অ্যান্ড ইট ইউর ভিটামিনস” এই কথাও হয়ে ওঠে এক কালজয়ী বার্তা।
ডব্লুডব্লুইর ইতিহাসে হোগান ছিলেন অন্যতম মূল মুখ। ১৯৮৫ সালে প্রথম রেসলম্যানিয়ার মূল আকর্ষণ ছিলেন তিনি। ডব্লুডব্লুইর বিভিন্ন পর্বে তিনি মুখোমুখি হয়েছেন আন্দ্রে দ্য জায়ান্ট, র্যান্ডি স্যাভেজ, দ্য রক, এমনকি কোম্পানির চেয়ারম্যান ভিন্স ম্যাকমোহনের সঙ্গে।
পরবর্তীতে WCW তে যোগ দিয়ে ‘হলিউড হোগান’ নামে একজন খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই চরিত্র তাকে নতুনভাবে জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ২০০২ সালে রেসলম্যানিয়ায় দ্য রকের মুখোমুখি হয়ে আবারও আলোচনায় আসেন তিনি।
তবে তাঁর জীবনে বিতর্কেরও অভাব ছিল না। ২০১৫ সালে একটি গোপন রেকর্ডিংয়ে বর্ণবাদী মন্তব্য শোনা যাওয়ার পর ডব্লুডব্লুই তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে। পরে ২০১৮ সালে তিনি হল অফ ফেমে ফিরে আসেন।
স্টেরয়েড ব্যবহার ও ব্যথানাশকের উপর নির্ভরতা সম্পর্কেও হোগান নিজেই স্বীকার করেছিলেন। দীর্ঘদিনের ব্যথা, শারীরিক চাপ এবং পারফর্ম করার টানাপোড়েনে তিনি শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হন। স্টেরয়েড ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে তার রাগের বিস্ফোরণ ও মুড সুইং লক্ষ করা যেত।
হোগান ছিলেন তিনবার বিবাহিত। তাঁর দুই সন্তান রয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ‘হোগান নোজ বেস্ট’ নামে এক রিয়েলিটি শোতে তাঁর পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন।
২০২৪ সালে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন জানান। তিনি জানান, নির্বাচনি প্রচারণার সময় এক হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ট্রাম্পের সাহসিকতাই তাকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে। আশির দশকে রেসলম্যানিয়ার আয়োজনে ট্রাম্প ছিলেন হোগানের অন্যতম সমর্থক।
হাল্ক হোগান ছয়বার ডব্লুডব্লুই চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ২০০৫ সালে ডব্লুডব্লুই হল অফ ফেমে যুক্ত হন। পরে ডাবল হল অফ ফেমার হিসেবে দ্বিতীয়বার স্থান পান।
২০১৬ সালে গকার মিডিয়ার বিরুদ্ধে একটি সেক্স টেপ মামলায় হোগানকে ১১৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয় আদালত। পরে আরও ২৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ হিসেবে যুক্ত করা হয়।
লাল-হলুদ পোশাকে, ‘রিয়েল আমেরিকান’ সংগীতের তালে রিংয়ে প্রবেশকারী হাল্ক হোগান হয়ে উঠেছিলেন রেসলিংয়ের ‘বেব রুথ’। স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে, টিভি শো, সিনেমা, মার্চেন্ডাইজিং সহ সবখানেই ছড়িয়ে ছিল তাঁর ছায়া।
আজ তাঁর শূন্যতা অপূরণীয়। হাল্ক হোগান আর নেই, তবে ‘হাল্কাম্যানিয়া’ চিরকাল রয়ে যাবে ভক্তদের হৃদয়ে।
সিটিজিপোস্ট/এমএইচডি