ঢাকাবুধবার, ১৩ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পাঠ প্রতিক্রিয়া – ‘দেয়াল’ – হুমায়ূন আহমেদ

মুহাম্মদ ইনজামাম খান
জুন ১, ২০২২ ১২:২১ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

আজকাল বই তেমন পড়া হয়না। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আমার কিশোর বয়সে বিনোদনের প্রধান উৎস ছিলো বই পড়া। বেশ কিছুদিন ধরে পাশের টেবিল থেকে হুমায়ূন আহমেদের শেষ উপন্যাস ”দেয়াল” উঁকি দিচ্ছিলো।আজ হাতে তুলে নিলাম এবং এক আসনেই শেষ!

বাংলাদেশের পাঠকশ্রেণীর পাঠ্য তালিকার একটা বড় অংশজুড়ে আছে কিংবদন্তি কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের নাম ও তাঁর সৃষ্ট কর্ম। পাঠক হিসেবে আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।

 

আমার শ্রদ্ধেয় ছোট চাচা মিজান উদ্দীন খান, একজন সাহিত্যিক মানুষ, মূল থেকে যার সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখি দর্শন করে আমি প্রথম লিখতে অনুপ্রেরণা পাই, তিনি আমাকে হুমায়ূন আহমেদের “দেয়াল” উপহার হিসেবে দিয়েছেন। উনার প্রতি রইলো অশেষ কৃতজ্ঞতা।

 

“দেয়াল” পড়া শেষে মনে হলো বিশাল এক পাথরখন্ড বুকের উপর চেপে বসেছে। ফিকশন ফ্যান্টাসির জগৎ থেকে বেরিয়ে কোনোদিন সেসমস্ত জাতির সূর্যসন্তান যাদের কল্যাণে আজ বাংলাদেশি পরিচয়ে স্বাধীনভাবে চলছি তাদের নিয়ে বিস্তারিত কোনোদিন জানা হয়নি। চট্টগ্রামের ভাষায় একটা প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে, ‘ঊঁইন্না হতা লই গুইন্না গওন’ অর্থাৎ লোকমুখে শোনা কথা, বিশ্বাস করে সেটি প্রচার করা। অত্যন্ত লজ্জাজনক হলেও বলতে হচ্ছে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন ও প্রতিষ্ঠালগ্নের ইতিহাস নিয়ে আমার দৌড় সেই ‘ঊঁইন্না হতা লই গুইন্না গওন’ এর মতো। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অস্থিরতা ও মর্মান্তিক ট্র‍্যাজেডি নিয়ে আমার জানাশোনা ছিলো খুবই সামান্য, যার কারণে মনে হচ্ছে চিন্তাভাবনার ও ইতিহাস শিক্ষার অন্যতম একটি দুয়ার ছিলো আমার জন্য বন্ধ।

 

সৌভাগ্যবশত “দেয়াল” সেই দুয়ার উম্মুক্ত করে আমাকে তার দ্বারে নিয়ে এলো। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা, মতবিরোধ ও ক্ষমতা দখলের নোংরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে একে একে প্রাণ দিলো এবং একে অপরের প্রাণ নিলো জাতির মহাবীরেরা, মূলত আকাশ ভারী করা এই কঠিন ইতিহাসের সরল আলোচনাকে উপজীব্য করে “দেয়াল” এর সৃষ্টিলাভ।

 

হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি কথা সত্য বলে ধরে নিতে হবে কথা নেই। ইতিহাস বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত হয়। কোনটা সত্য জেনে লাভ নেই, কারণ পাঠক কখনো নিরপেক্ষ থাকতে পারেনা, থাকাটা খুব কঠিন। তবে “দেয়াল” কোনো ফাঁকা বুলি নয়। তা কেনো নয় বলছি- পাঠকগণ খেয়াল করে থাকবেন, হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ কালজয়ী উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের বিষয় বারবার উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণার মধ্যেই লেখকের সাহিত্যিক হয়ে উঠা, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের লেকচারার হিসেবে থাকার সুবাদে মোটামুটি বহু বিশেষ ব্যক্তিবর্গের সাথে তাঁর উঠা বসা ছিলো। ঢাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোর সাথে লেখকের পরিবারের ছিলো সখ্যতা। “দেয়াল”- এ উল্লেখিত ঘটনা গুলো বিভিন্নভাবে লেখকের জীবনের জড়িত, তাছাড়া তাঁর সারাজীবনের পড়াশোনার ছাপ তো রয়েছেই, তা উপন্যাসটির শেষে ত্রিশটি তথ্যসূত্রের উপস্থাপনই প্রমাণ করে। তাই “দেয়াল” কোনো মনের মাধুরী মেশানো ফেলনা নয়!

 

লেখক যখন হুমায়ূন আহমেদ, রসবোধ তো থাকবেই। সরাসরি কাঁচা ইতিহাস পড়ে পাঠকরা শান্তি পাবেননা বা গভীরতা উপলব্ধি করতে পারবেন না, তা লেখক ভালোভাবেই জানতেন। তাই শুরুটা অনেকটা ফিকশনের মতোই। কিন্তু কখন সেই ফিকশন আপনাকে ধরে নিয়ে চরম বাস্তবতার মুখোমুখি করবে আপনি টেরই পাবেননা, শুরুর সেই ফিকশনও রূপান্তরিত হবে তিক্ত বাস্তবতায়।

 

উপন্যাসের শুরু হয় অবন্তি, তার গৃহশিক্ষক শফিক ও অবন্তির দাদা সরফরাজ খানকে দিয়ে। সহজসরল ধারা বিবরণী ও উপস্থাপনে মনে হচ্ছিলো কাল্পনিক চিত্র, কিন্তু যখন দৃশ্যে তাদের মাঝে মহাবীর খালেদ মোশাররফের আগমন ঘটে, ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়া উপন্যাসের শেষে শফিক, অবন্তি ও সরফরাজ খান পরিণত হয় বাস্তব চরিত্রে। ইতিহাসের চরিত্ররা একে একে উঠে আসতে থাকে যত পৃষ্ঠা আগাতে থাকি। জাতীয় চারনেতা, মহাবীর কর্ণেল তাহের, মেজর জেনারেল ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাক, কর্ণেল ফারুক, মেজর রশীদ, মেজর ডালিম এবং প্রমুখ বিশেষ ব্যাক্তিগণ।

 

জাতির শ্রেষ্ঠ বীরদের একে অপরের বিরুদ্ধে এমন লড়াই কেনো হয়েছে সে বিতর্কে যেতে চাইনা। অবশ্যই পা চাটাদের বাড়াবাড়ি, ক্ষমতার লোভ ও বিদেশি শক্তির রাজনৈতিক চাল তো ছিলো ই কারণ হিসেবে। “দেয়াল” পড়তে গিয়ে বারবার আবিষ্কার করেছি এরিস্টটলের ‘হ্যামারশিয়া’। এরিস্টটল তাঁর “পোয়েটিক্স” – এ ‘হ্যামারশিয়া’ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আলোচনা করেন, প্রত্যেক বীরেরই এমন একটি বড় ভুল থাকে, যার মাশুল খুব ভয়াবহভাবে গুনতে হয় সেই বীরের, হয়তো জীবনের বিনিময়ে অথবা সারাজীবনের অর্জন ও সম্মান ধূলিস্যাৎ করে। ‘হ্যামারশিয়া’ ভর্তি হোমারের “ইলিয়াড” যেনো পুনরায় রচিত হলো আমাদের মহাবীরদের রক্তস্রোতে।

 

পাঠের শুরুতে হুমায়ূন আহমেদের শেষ উপন্যাস ”দেয়াল” এর মাসুম রহমান কর্তৃক তৈরি প্রচ্ছদ বা মলাট কিংবা টাইটেল আমাকে ভাবায়নি। পড়ার শেষে আমি কোনো মলাট বা টাইটেল দেখিনি, চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির রক্তাক্ত দেয়াল, জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া সেলের রক্ত দ্বারা অঙ্কিত দেয়াল, ক্যান্টনমেন্টের প্রতিটি দেয়ালে রক্তের স্রোতে চিত্রিত রক্তনদী, ফাঁসির মঞ্চের আশেপাশের দেয়ালের বীর সেনানীদের রক্তস্রোতের শব্দ, সার্কিট হাউসের দেয়ালে ছিটকে পড়া রক্ত!

 

“দেয়াল” – হুমায়ূন আহমেদ

মাজহারুল ইসলাম কর্তৃক প্রকাশিত, অন্যপ্রকাশ।