ঢাকাশুক্রবার, ২০শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সামাজিক বৈষম্য ও দুর্নীতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মূল কারণ

Link Copied!

বর্তমানে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলেছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সমাজের একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাজার বছর আগের দ্রব্যমূল্য আর বর্তমানে দ্রব্যমূল্য আকাশ-পাতাল ব্যবধান। সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি হলে, চাহিদা বেড়ে জোগান কম হলে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কখনো অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। সেটা হতে পারে সামাজিক বৈষম্যের ফলে কিংবা অসাধু ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির কারণে। তা যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য হয়। তবে সাধারণ জনগণের জন্য বিষয়টি দুঃখজনক হয়ে দাঁড়ায়।

 

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য অন্যতম। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা রয়েছে। এ পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণ হলে মানুষ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। যার মধ্যে অন্যতম খাদ্য। খাদ্য ছাড়া মানুষের একদিন চলে না। আমাদের বাংলাদেশের মানুষের ক্ষেত্রে খাদ্য তালিকায় অন্যতম দ্রব্য চাল, ডাল, মাছ, মাংস, আলু, তেল, মসলাজাতীয় দ্রব্য, শাক-সবজি ইত্যাদি।

 

দ্রব্যমূল্য বাড়লে সাধারণত ধনী শ্রেণির মানুষ কিছু মনে করে না। তবে গরিব শ্রেণির মানুষ বিপাকে পড়ে। পেঁয়াজ সংকটে পেঁয়াজের দাম আকাশচুম্বি হয়। আবার কিছুদিন ধরে আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক আলুর দাম সর্বোচ্চ ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা সাধারণ জনগণের জন্য স্বস্তির সংবাদ। কিন্তু মাঠপর্যায়ের বাস্তবায়নও জরুরি। এ ছাড়া খুঁজে বের করা প্রয়োজন বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পেছনের রহস্যগুলোকে।

 

অর্থনীতিতে বলা হয়, চাহিদা বাড়লে মূল্য বাড়ে। কিন্তু যদি পর্যাপ্ত জোগান থাকে তাহলে দাম বাড়ার কথা নয়। বাংলাদেশ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যমতে, বাজারে পর্যাপ্ত আলু রয়েছে। তাহলে মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি স্বাভাবিক আসেই না বরং সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রয়েছে যারা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ করে না আবার বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে দাম বাড়ায়। যার প্রভাব পড়ে খেটে খাওয়া জনগণের ওপর। এর প্রভাবে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে।

 

লোভে পড়া মানুষের লোভ কমানো যায়। কিন্তু পেটের দায়ে চুরি করে তা হলে কোনো উপায় নেই। পেটে খাবার না এলে নীতিবাক্য কাজে আসে না। বাংলাদেশে আগে ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষই তার প্রমাণ। শুধু অসাধু ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হলে তাও ভুল হবে। সমাজের প্রতিটি মানুষ চায় আরামদায়ক জীবনযাপন করতে। যত কম পরিশ্রমে সম্ভব, তত ভালো। ধনী গরিবের বৈষম্য এ দেশে এখনো বিদ্যমান। তার অন্যতম কারণ হলো অর্থ ও প্রতিপত্তি।

 

 

সারাদিন মাঠে-ঘাটে কাজ করে দিনে শেষে ৫০০-৭০০ টাকা আয় করে যখন দেখে অল্প পরিশ্রম করে হাজার হাজার টাকা পায় তখন তারও ইচ্ছা জাগে বেশি আয় করার। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অনেকের ফসলি জমি নষ্ট হয়, অনেকে ঋণে জর্জরিত থাকে আবার সবার ভালো ফলন হয় না। তখন সেটি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য ও মজুরি ও পাইকারি বৃদ্ধি পায়। বেশির ভাগ সময় দেখা যায় যে ধানের জন্য কৃষকরা পর্যাপ্ত দাম পান না। এতে কিন্তু বাজারে চালের দাম কমে না। ফলে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দাম বৃদ্ধি করে।

 

অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন নীতিমালা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ‘দ্য অ্যাসেনশিয়াল আর্টিকেলস অ্যাক্ট, ১৯৫৩’, ‘কন্ট্রোল অব অ্যাসেনশিয়াল কমোডিটি অ্যাক্ট, ১৯৭৬’, ‘অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি নিয়ন্ত্রণ আদেশ ১৯৮১’ ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ, ২০১১ অন্যতম। ভোক্তাদের জন্য রয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯। সমন্বিতভাবে ভোক্তা অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ নিয়ে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়।

 

 

গণমাধ্যমের বিভিন্ন সংবাদে দেখা যায়, বিভিন্ন জায়গায় এ সব ব্যবসায়ীদের হাতেনাতে ধরে অর্থদন্ড দেওয়া হচ্ছে। তবুও থামছে না। ভ্রাম্যমাণ আদালত চলে গেলে আবার শুরু হয়। সম্পূর্ণ বাজার কতিপয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে থাকে। এখানে মাঠ প্রশাসনের তদারকিই যথেষ্ট নয় বরং ভোক্তার তথা জনগণকে দ্রব্যমূল্যের বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং প্রশাসনকে সাহায্য করতে হবে।

 

একজন খেটে খাওয়া কৃষক তার প্রাপ্য নায্যমূল্য পেয়ে প্রত্যেক স্তরের ব্যবসায়ীদের নির্ধারিত মূল্যে চার্ট থাকা ও মাঠ প্রশাসন দ্বারা সুষ্ঠু তদারকির প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে জনগণের পক্ষে স্থানীয় সরকার প্রশাসন ও সহযোগিতা করতে পারে। আমাদের সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে সবার মধ্যে বিত্তশালী হওয়ার ইচ্ছা জাগে। যার ফলাফল ভয়াবহ। অনেকেই চায় অল্পতে অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করতে। এ সব চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এলে দুর্নীতি কমে যাবে। এ ছাড়া শ্রমের ওপর মানবণ্টনেরও প্রয়োজন আছে। একজন মানুষ অল্প কাজে অধিক আয় অন্যকেও অধিক আয়ের জন্য আগ্রহ বাড়াতে পারে। সব স্তরের ও সব পেশার মানুষ নায্য অধিকার এবং সম্মান পেলে দুর্নীতিসহ অনেক অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব।