আল মাহমুদের শূন্যতা ইমরান মাহফুজ।
আল মাহমুদ, যার কবিজীবনের সঙ্গে দারুণভাবে মিশে আছে বাংলাদেশের বাঁক-বদলের ইতিহাস। স্বদেশের শক্তি বুকে নিয়ে, চোখে জাতির স্বপ্ন দিয়ে লিখে গেছেন এক জীবন। তাছাড়া আধুনিককালের কবিদের মধ্যে যিনি শব্দ চয়নে, জীবনবোধে, শব্দালংকারের নান্দনিকতায়, বর্ণনায় অসামান্য, তিনি কবি আল মাহমুদ। এমন কবিই বলতে পারেন—
‘আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।
উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোন দিনই বিহবল করতে পারেনি।
আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,
আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মূতার প্রান্তর।
পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত!’
কবিতায় বিশ্বাসীদের অনুভূতিকে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন। তার সেই চেতনাকে মূর্ত করেছেন শব্দে, অনুভূতির অবয়বে। ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি, প্রকাশ পেয়েছে দৃঢ়তা আর জীবনের গন্তব্য, তাতে নেই সংশয়, শঙ্কা। আমৃত্যু কবিতার খাতায় এঁকেছেন বাঙালিয়ানার এক চিরায়িত ছবি। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থটি একটি মাস্টারপিস হিসেবেই সমাদৃত হয়েছে, এমনকি কবির একচোখা সমালোচক ও নিন্দুকদের মাঝেও।
আমরা দেখি আধুনিক কবিতার একটি মৌলিক বিষয় শব্দের সমাহার বা চিত্রকল্পের ব্যবহার। এ ক্ষেত্রে আল মাহমুদ গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যকে আশ্চর্য শক্তিময় শব্দ বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদী জনপদ, চরাঞ্চলের জীবন এবং চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন।
প্রখ্যাত সমালোচক অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন- ‘সমকালীন যে দুজন বাঙালী কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্রোপাধ্যায়।’
অধ্যাপক ড. রাজীব হুমায়ুনের মতে, ‘তিনি চল্লিশের পরবর্তী কবিদের মধ্যে অন্যতম মৌলিক কবি, নতুন কবি। সমালোচকরা তার মৌলিকত্ব এবং নতুনত্ব দেখেছেন আল মাহমুদের গাঁয়ে ফেরার পিপাসায় এবং অনিবার্য শব্দ, উপমা ও চিত্রকল্পে সে পিপাসার প্রকাশে।’
মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং একের পর এক সাফল্য লাভ করেন। ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন ১৯৬৮ সালে।
ভাষা আন্দোলনের সূত্রে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসেন। আবার কবি গ্রামে ফিরলেন এবং প্রামের মেঠো পথ বেয়ে চলতে গিয়ে রচনা করলেন: এখন কোথায় যাওয়া যায়?/ শহীদ এখন টেলিভিশনে।/ শামসুর রাহমান সম্পাদকীয় হয়ে গেলেন।/ হাসানের বঙ্গজননীর নীলাম্বরী বোনা/ আমার দ্বারা হবে না। জাফর ভাই ঘোড়ার গায়ে হাত বোলান।/ অতএব কবির কোথাও যাওয়া হলো না, কেন না/ আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি তালা ঝুলছে। (আমার সমস্ত গন্তব্যে)
আল মাহমুদ লোকজ অভিমুখে যাত্রা করে লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করলেন। তার নির্মিত পটভূমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতাই আত্মবিশ্বাস। জসীম উদ্দিন এবং জীবনানন্দ উভয়ের থেকে তিনি সম্পূর্ন ভিন্ন প্রকৃতির কবি। কারও প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে। ক্রমশ হয়ে উঠেছেন আস্থাশীল এক কাপ্তান। আল মাহমুদই আমাদের বিপুল জনসমষ্টির জীবনধারার অভিজ্ঞতাকে কবিতায় ব্যবহার করেছেন—
‘আমার বিষয় তাই, যা গরীব চাষীর বিষয়/ চাষীর বিষয় বৃষ্টি ফলবান মাটি আর/ কালচে সবুজে ভরা খানা খন্দহীন/ সীমাহীন মাঠ।/ চাষীর বিষয় নারী।/ উঠৌনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা।/ পুর্নস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী।’ (কবির বিষয়)
স্পন্দমান আবেগের ভূগোল, দেশজ চেতনা, লোককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। যেমন তিনি তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’ এ মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনুষঙ্গসমূহ। তিনি এখানে শক্তিমত্তার সঙ্গে রোমান্টিসিজম প্রবেশ করিয়েছেন যা ‘সোনালী কাবিন ‘সনেট গুচ্ছকে করেছে অন্যান্য।
‘সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি/ আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি/ আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;/ ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।’
আসলে ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রিয়জনকে দিতে কোনো অর্থ-বিত্ত বা দেন মোহর কোনো কিছুই গুরুত্ব বহন করে না ভালোবাসা ছাড়া। তাই কবির এইসব পঙক্তিতে বিনয়ের উদার বটপাতায় ভেসে উঠেছে ভালোবাসার চিত্র। ‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছ কবি উপমা-রূপকের চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন, আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল। গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে কবি উন্মোচন করেছেন, নদীর চরের প্রতি কৃষাণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমাণিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙক্ষার ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় নর-নারীর কামনার চিত্র।
এইতো আমাদের আল মাহমুদ এবং তার গ্রামীন প্রান্তরের উপঢৌকন যেখানে যৌনতার আন্তরিক অভিব্যক্তি ঘটেছে:
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল/ পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না/ তুমি যদি খাও আমাকেও দিও সেই ফল/ জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা (সোনালী কাবিন)
কবি অতীত গৌরব, সাম্য মানসিকতা, ইতিহাস থেকে ঐতিহ্য, কাম থেকে প্রেম এবং কামকলার অভূতপূর্ব চিত্রায়ণের সঙ্গে ধর্মের মিথলজিক্যালের ব্যবহার করেছেন। আল মাহমুদ মানুষের মানবিক মেধা ও মননের বিষয়গুলো খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। কবির দৃষ্টিভঙ্গি যুগপৎ সমাজনিষ্ঠ।
একজন কবির বড়ত্ব তার কাব্যভাষা, চিত্রকল্প এবং ছন্দের নতুনত্বে। আল মাহমুদের বড়ত্ব তার নিজস্ব বাকরীতি প্রবর্তনে এবং অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প নির্মাণে। সৌন্দর্য বিভায় উদ্ভাসিত তার কবি হৃদয় সর্বদা সুন্দরের পূজারী। তিনি তার কাব্যে বহু বিচিত্র বিষয়ের চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন।
উল্লেখিত রচনায় কবি করেছেন নারী সৌন্দর্য্য বন্দনা। আর আল মাহমুদের নারী অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক, কামোদ্দীপক ও সৌন্দর্য্যময়ী। এক্ষেত্রে অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের মন্তব্যটি যথার্থ: ‘তিনি বোদলেয়ারের অনুরাগী। কিন্তু মাটি তার কাছে সেই নারী যে, জলসিক্ত সুখদ লজ্জায় নিজেকে উদাম করে। তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার। অভাবের অজগর তার টোটেম। যে কিসিমে শিষ্ট ঢেউয়ের পাল রাতের নদীতে ভাসা পানকৌড়ি পাখির ছতরে ছলছল ভাঙে সে কিসিমেই তিনি তার বানুর গতরে চুমো ঢালেন।’ (একজন খাটি কবি)
অন্যদিকে সাহিত্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কবিতার মেজাজ ও মন বুঝতে সহজে হলে আমাদের আল মাহমুদের সংসারে প্রবেশ করতেই হবে—
‘কবিতা কি?
কবিতা তো শৈশবের স্মৃতি
কবিতা চরের পাখী, কুড়ানো হাসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
স্নান মুখ বউটির দড়িছেড়া হারানো বাছুর
কবিতা তো মক্তব্যের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’
শুধু তাই নয়, কবির কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাস। তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার কথাও স্মরণ করেছেন, আর সেই মৃত্যুচিন্তার অনুভূতিগুলো ফুটে উঠেছে বিদগ্ধ শব্দচয়নে-
‘স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক/ অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?
কেন দোলে হৃদপিণ্ড, আমার কি ভয়ের অসুখ?/ নাকি সেই শিহরণ পুলকিত মাস্তুল দোলায়!
আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার/ যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।’
আবার ‘স্মৃতির মেঘলাভোরে’ কবিতায় তার ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কবি। লিখেছিলেন- কোনো এক শুক্রবারের ভোরবেলা মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে ডাক দিলে তিনি খুশি মনেই তার ডাকে সাড়া দেবেন। আনন্দের সঙ্গেই তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন।
২০১৯ সালে আজকের দিনে শুক্রবার রাতে রাজধানীর এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। শারীরিকভাবে চলে গেলেও কবি থাকবেন লোক লোকান্তরে, মানুষের কাছে। জীবিত কবির চেয়ে কবিতায় থাকা কবি অনেক শক্তিশালী। আর দুর্গম পথ মাড়িয়ে আসা শক্তিমান কবির শূন্যতা থাকবে।