মাহমুদ হাবিব হিমেল। মঙ্গলবার (১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার সময়ও বন্ধুদের সঙ্গে হাসি-আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন।
সেই হিমেল আর আমাদের মাঝে নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেখানে বন্ধু-সহপাঠীদের সঙ্গে শিক্ষা-গবেষণার কাজে ছোটাছুটি করতেন, সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
ক্যাম্পাসে নির্মাণকাজে যুক্ত থাকা একটি ট্রাকের চাপায় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে। হিমেলের শরীর থেকে মাথা আলাদা হয়ে গেছে। হিমেলকে বহন করা মোটরসাইকেলটিও ঘটনাস্থলে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনের রাস্তায় মঙ্গলবার রাতে হিমেলের মাথাবিহীন মরদেহটি পড়েছিল দীর্ঘক্ষণ। এটাই কি হওয়ার কথা ছিল? ক্যাম্পাসে ট্রাকের চাপায় এভাবে শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনা এর আগে হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের জন্য। সেখানে শতভাগ নিরাপদে শিক্ষার্থীরা ঘুরে বেড়াবেন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন, শিক্ষা-গবেষণা চালিয়ে যাবেন-এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই ক্যাম্পাসেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হিমেলকে প্রাণ দিতে হলো। এর থেকে কষ্টের বিষয় আর কী হতে পারে।
হিমেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষে পড়তেন। তাকে নিয়ে পরিবারের অনেক আশা ছিল। মেধাবী এই ছাত্র একদিন পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করতেন। কিন্তু না, সেটা আর হলো না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট এবং স্বেচ্ছাসেবী রক্তাদাতা সংগঠন বাঁধনের সঙ্গে কাজ করতেন হিমেল। অসুস্থ রোগীর রক্তের সন্ধানে ব্যস্ত থাকা হিমেলের রক্ত এই ক্যাম্পাসের রাস্তায় গড়াগড়ি করবে, তা কে জানত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার হিমেলকে নিরাপদে তার পরিবারের কাছে ফেরত পাঠাতে পারল না। মাথাবিহীন লাশ তার পরিবারের কাছে দিল। এই নিষ্ঠুরতার কী জবাব দেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়? এর দায় আমাদের, সমাজ ও রাষ্ট্রের। হিমেলদের মতো শত শত প্রাণ এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। সবাই যেন নির্বিকার। কেউ কোনো দায় নিতে চায় না।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর হিসাবমতে, ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক, নৌ ও রেলপথে ৪ হাজার ৯৮৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৬৮৯ জন। এছাড়া আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৮০৫ জন।
এক বছরে শুধু দুর্ঘটনায় প্রায় ৫ হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয় যে দেশে, সেখানে একজন হিমেলের প্রাণের দাম যে কত তা সহজেই বোঝা যায়। তাই এই অরাজকতার মধ্যে সাধারণ মানুষদের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
এত হতাশা পেছনে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো অনেক আশা নিয়ে এসেছিলেন হিমেল। সেই আশা এই ক্যাম্পাস কেড়ে নিয়েছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে ক্যাম্পাসের ভেতরেই। যদিও এই ক্যাম্পাস চলাচলের জন্য শতভাগ নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি। এর দায় শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নয়। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দায় পুরো সমাজের।
শহীদ শামসুজ্জোহা হলের আবাসিক ছাত্র হিমেলের কক্ষের সামনে এখনো রয়ে গেছে কয়েকটি কারু শিল্প। কিন্তু হিমেল সেখানে নেই। হয়তো কয়েক দিন পর তার সেই কক্ষটিতে অন্য একজন শিক্ষার্থী উঠবেন। কিন্তু এই ক্যাম্পাসে হিমেলের যে রক্তের দাগ লেগে গেল, তার দায় আমরা কাকে দেব?
লেখক: সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বাংলানিউজ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র